আখর :
ঠমকি ঠমকি চলি যায় রাইআলি
সন্ধিত্সা লইয়া মননে
নয়ন পুত্তলি অস্থিরা চঞ্চলি
ঘুরিয়া ফিরে বৃন্দাবনে।
চরণে ঘাঘর তোলে ঝুমঝুম ঘোর
কেশদামে দোলে বিউনী ,
মৃদু-মন্দ গামী চপলা দামিনী
মৃগয়াতে চলে বাঘিনী।
চুপিসাড়ে প্রবেশি মদনকুঞ্জে আসি
নিরখিয়া দেখে চারিপাশ -
কোথা সিতবদনী রাধার নয়নমণি
না হেরিয়া ভাঙি যায় আশ।
ক্রমে ক্রমে পরে রাধাকুন্ডনীরে
ধীরপদে করিল গমন ,
কোথা কালাচাঁদ নাই দ্বাদশ বনেতে যাই
তমস হইল বদন।
হটাৎ চাহিয়া দেখে বট বৃক্ষের ফাঁকে
খাড়াইয়া আছে বলরাম ,
সঙ্গে কেশব নাই চাহিয়া হেরিল তাই -
শুধু হরিসখা সুদাম।
দেখিয়া ভাবিছে মনে সহসা কি কারণে
খুঁজে নাহি পাই ঘন্শ্যামে
কোথা সে মধুর ধ্বনি যাহা অহোরাত্র শুনি
তল না পাইল মরমে।
না ত্যাজিয়া বাসনা কতেক আনমনা
উপনীত হল যমুনাকূলে -
সেথা কি দেখিল সে বিস্ময়ে নির্নিমেষে
হেরে হরি বট বৃক্ষ মূলে।
বিলুন্ঠিত তরুতলে তনু মসী হল ধূলে
আকুলি-বিকুলি করয়ে রোদন ,
উত্তরী খসে যায় প্যারী প্যারী আওড়ায়
অশ্রুনীরে স্নান সমাপন।
বেণু দিছে গুঁড়ো করি পেখম খসিছে পড়ি
ধূলি-ধূসর তনুরুচি -
চিনিতে কষ্ট হয় হেরিয়া দুঃখ পায়
এই কি সে রঘুকুলপতি ?
এক্ষণে পড়িল মনে নদীতটে কি কারণে
ঘটিয়াছে তার আগমণ ,
মনব্যাথা মনে পুরে রাধিকানন স্মরে
ভাবে বসে কি করিবে এখন।
হেনকালে দেখে হায় সে গোবিন্দ ফিরে চায়
অপলক চোখে তার পানে
অক্ষিপটে নীরকণা উজলিছে যেন সোনা
বিমর্ষ বদন বেদনে।
দুখে বুক ফাটি যায় মন হাল ধরে তায়
সখী লাগি করে চাতুরী ,
না দেখিয়া ভান করি সরে যায় তাড়াতাড়ি
কটাক্ষে হেরে শ্রীহরি।
চিনিয়া সে সহচরী আকুল হইয়া হরি
ডাকি কয়, "শুন বিধুমুখী -
মোর পানে ফিরি যাও শুধু কৃপা করি যাও
প্রেমাঘাতে আমি বড় দুঃখী।"
কৃত্রিম ক্রোধ ভরে বৃন্দে উত্তর করে,
"শুভকাজে কি পড়িল বাধা !
বোধহয় ডাকিছে মোরে পুরুষালি কন্ঠস্বরে
কাহার এমন বুকের পাটা !"
বলিয়া ভ্রুকুটি হানে উপহত হরি পানে
আননে ছলকে বিজুলি
মৃদুলা সংসর্পিণী হইয়া অগ্রবর্তিনী
বিলোকন করে মূরলী -
বলে,"কি বলিতে চাহ বল বহিয়া যেতেছে পল
কত কাজ পড়ে আছে যে !
বাহিরিলা শুভকাজে পিছু ডাকি দিলা মাঝে
না জানি কি আছে ভাগ্যে !"
এত শুনি রাঘবন দুহাতে মুছিয়া নয়ন
করজোড়ে নতবদনে
কহে,"বলি শুন শুভাননী অভাগা অতীব আমি
মার্জনা কর নিজগুণে।
যে পলে হইল দেখা তব প্রানাধিকা সখা
সে অবধি তিরোহিত শান্তি
হরিণী যেমতি করে কস্তুরী লাগি মরে
মোর ঘটিল কি সেই ভ্রান্তি !
চঞ্চলা সদা মন মদিরা পিবয়ে যেমন
বিমোহিত করিল বামা ,
কি তাহার নাম কহ, কোথায় বা বাসগৃহ
কে সেই রমা অনুপমা ?"
হরষে তরঙ্গ বয় বৃন্দার অঙ্গময়
ভুরুপানে খেলে বিজুরি
অধর রুধিয়া দাঁতে ভাবে প্রফুল্ল চিতে
পনস তোড়িবে শিরোপরি।
কতেক ভাবিয়া কয়, "শুন ওগো মনোময়
কি লভিবে নাম শ্রবণে -
সে রাজার ঝিয়ারী শ্রীরাধিকা সুন্দরী
হেই বলে ব্রজবাসীগনে।
আমাদের প্রিয়া সই হ্লাদিনী রাধা কই
কুপিত সে আজি তোমাপানে
তাই বলি ভুলি যাও আশা তার ছাড়ি দাও
নাহি লাভ অলীক স্বপনে।"
শুনিয়া নন্দলালা বিস্ময়ে কহিলা -
"এমত কি হইবারে পারে ?
যারে এত ভালোবাসি কিকরে সে রয় উদাসী
নিরাকুল হয়ে মোর পরে ?
যে প্রেমানলে পুড়ি সবকিছু বিস্মরি
সে জ্বালা কি মোর একার ?
তব রাধিকার মন সে কি পাষানসম
গলিবে না কি একবার ?
হে বলা মনোরম কর কৃপাবলোকন
তুমি মম বাঞ্ছা-কল্পতরু -
অভাগা অকিঞ্চনে পুরাও আকিঞ্চন
ভয়ে বুক কাঁপে দুরুদুরু। "
এত বলি শৌরে ভুর্জপত্রপরে
কম্পিত হস্তে রচিল -
শুধু দুইখানি পদা 'ভালোবাসিয়াছি রাধা'
সাথে দুই ফোঁটা জল ঝরিল।
তুলি দিয়া লিপিখানি কইলো , "বৃন্দারানি -
এই নাও মোর সন্দেশ ,
নিংড়াইয়া মন যা পেনু এই ধন
নির্ধন হনু শেষমেষ।
যাইয়া কহিও তারে ভালোবাসিয়াছি যারে
ভুলিতে না পারিব কভু ,
এরপরে তার মন যা ভালো বুঝে খন
বিচার করিবেন প্রভু।
প্রায়োপবেশনে বসিলাম এই ক্ষণে
না হেরিয়া মুখ তাহার
ছুঁবো না অন্ন-জল তেয়াজিনু সকল
পড়িয়া রহিব এই পার। "
লিপিকা লইয়া হাতে উত্তরিলা সোত্প্রাসে
সুচতুরা রাই সহচরী -
"এত ঢং অকারণ শিখিলে কবে কখন
কহ দেখি বিপিনবিহারী ?
তুমি সখা বৈরী বুঝিলে শ্রীহরি
তোমা লাগি করিলে কথন -
সখিহীনা হব আমি সেই ভালমত জানি
রব একা চিরদিন মতন।
আর না ডাকিও মোরে যাই এবে ত্বরা করে
কতো কাজ পড়ে আছে মোর। "
বলি এক পলকে চলি গেল ঝলকে
একা পড়ি ব্রজকিশোর ;
চাতক যেরূপে হায় গগন পানেতে চায়
হেরে হরি বৃন্দার বিদায় -
তদুপর রোদনে ভেঙে পড়ে মনে মনে
স্তনন ধ্বনি তুলে, "হায় হায়"
নিরখিয়া শুক ভাসে নয়নের বারি মাঝে
(বলে)," - এই বুঝি পিরীতির ধারা !
প্রথমে কাঁদিতে হবে তবে সে রতন পাবে
নয় কেহ নাহি দিবে সাড়া !"
সারী শুনে কয় হেসে প্রিয়তমে ভালোবেসে -
"সখা কেন হও উতলা -
পোহাবে বিষাদ রাতি উদিবে মধুর ভাতি
একে অপরের জড়াইবে গলা।
গোলাপ তুলিবারে লালী যদি নাহি ঝরে
বুঝিবে না গোলাপের মর্ম ,
লভিতে হইলে কিছু আঘাত পাইবে পিছু
এই জেনো বিধাতার ধর্ম।
(সপ্তম অঙ্ক সমাপ্ত)