আখর (শ্রীরাধিকার উদ্দেশ্যে) :
হেরিয়া চপলা মিতা শুনিয়া তাহার কথা
অধীরা পড়িল সেই চিঠি
দুইটি মাত্র কথা যেন কত মধু মাখা
পিবয়ে মদির হল আঁখি।
রক্তাভ বদনে বিরহ বেদনে
রোদন করে অকারণ -
স্বপন জড়িমা ঘেরে হেরে শুধু শ্রীহরে
যেথা যেথা ধাইল নয়ন।
অদ্ভূত পুলকভারে পুরা তনু বিবশ করে
ভূমি পরে উপবিশল ,
মন কালা কালা জপে অঙ্গ থর থর কাঁপে
প্রেমজ্বরে জ্ঞান হারাইল।
সে দেখিয়া মিতালি দিয়া করে করে তালি
আনন্দে গাহিয়া উঠিল -
"সুখের সেদিন বুঝি আসিয়া পড়িল আজি
প্রেমবানে বাঁধ ভাঙ্গিল।
আমাদের পরানপ্রিয়া ঘনশ্যামে মজিয়া
সে গরলে হল অচেতন ,
মোরা আনন্দে নাচি শুধু প্রেমসুধা যাচি
যেইটুকু হইবে স্খলন।"
এত বলি সহচরী দিয়া শীতল বারি
রাধিকার ধ্যান ভাঙাইল ,
এবারে ঘিরিয়া তারে সকলে সমস্বরে -
গানে গানে তারে পুছিল,
"কি হল গো সখা রাই মুখে কেন কথা নাই
কার লাগি হইলে কাতর ?
কি আর হইবে লাভ শুধু করিয়া বিলাপ
খুলিয়া দাও প্রেমডোর।
বুঝিলে তো এইক্ষণে উভয়েতে মনে মনে
দগ্ধিছ প্রেমানলে
এ আগুন নিভিবে না রোদন থামিবে না
যদপি না মিলিছ গলে।
তাই বলি শুন রাই যতন করি সাজাই
তোমারে আমরা সখিগণে ,
ভ্রামর যেমতি করে লৌহপিন্ডেরে ধরে
ধরে হরি মারো সেইক্ষণে।
দুলিবে দুইজনে ব্রজ নিকুঞ্জবনে
কুসুম সুসজ্জিত ঝুলনে
ভাগ্যবান মোরা সই তোমা পানে চেয়ে রই
পুলক নির্নিমেখ নয়ানে। "
এত শুনি রাধারাণী মেলিল নয়নখানি
হায়াভরে আনত নয়ন
বেনীখানি লয়ে হাতে অতীব সাবধানেতে
করে তাহার কেশের যতন।
যেন কিছু শুনে নাই বা কিছু বুঝে নাই
হেনভাবে সে তাকাইল -
ধীমিত কন্ঠস্বরে যাহা ভেসে আসে দূরে
এমতভাবে কহিল -
"মোরে কিছু কয়ো না যা ভালো বুঝো করো না
সহিতে না পারি এ জ্বালা
যাহাতে জুড়াইবে শান্তি বরষিবে
তাহাতে হইবে মোর ভালা।
কৈতব ত্যাজি আজি এ মনের কারসাজি
স্বীকার করি নিজ মুখে -
কালাপ্রেমে পুড়িয়াছি পুড়িয়া মরিয়াছি
মাধব বিরহ দুখে।
ভালোবাসিয়াছি তারে নিজাপেক্ষা প্রিয় করে
মন মোর নিজ পরে নাই -
সেই সিতি রূপ লাগি হিয়া হয় বৈরাগী
দরশন লাগি কাতরাই।
তোমাদের ব্যতিরেখে কাহাকে কহিব হেঁকে
এ মোর মন যাতনা ,
সই যদি হও মোর ঘুচাও এ মায়াডোর
পুরাও মনের বাসনা। "
শুনিয়া সখীগণ সমস্বরে কহিল -
"ধীরে সই ধীরে রে -
ঘুচিবে তর মনজ্বালা
ধীরে সই ধীরে রে -
মিলবে মদের রাই - কালা
ধীরে সই ধীরে রে -
কষ্ট পরে কেষ্ট মিলে
ধীরে সই ধীরে রে -
দুলবে তুমি প্রেমঝুলে
ধীরে সই ধীরে রে -
আরো বলে -
উতলা হয়ো না সখী শুনো দিয়া মন
পিরীতির রীতি আজ করি বরণন -
পুরুষের পরে কভু কোরো না প্রত্যয়
নারী জাতি পরে তারা সদা নির্দয়।
প্রেমীকে বাঁধিবে কষে প্রেমজাল দিয়া
তোমা বিনা হয় যেন বিচলিত হিয়া ,
জাগরণে ঘুম ঘোরে সদা মনে মনে
রাধা রাধা জপে যেন বিরহে, মিলনে ,
যদি কভু ডাকে কাছে প্রেমাবেশে ভরে
চতুরালি বিরচিয়া হেলাইবে তারে ;
কভু না দিবে ধরা প্রেম-বাহুপাশে ,
আঁখিঠারে প্রেমজ্বালা জ্বালি চিদাকাশে
পঞ্চশর জাঁতাকলে ধরিয়া তাহারে
নিশিদিন নিপীড়নে মারিবে অন্তরে।
যেমত কহিলাম সেমত করিয়া
ডুব দাও প্রেমনীরে হরষিত হইয়া
না পাইবে মন-ব্যথা কভুও বেদন
প্রাণপ্রিয় সখী তুমি করি নিবেদন।
কাল সারাদিন ধরি মোরা সব সহচরী
তোমারে সাজাইব যতনে,
অতনু বাঁধিয়া রূপে অতঃপর চুপে চুপে
পাঠাইব পিয়া দরশনে।
দূর হইতে দেখিবে নিকটে নাহি যাইবে
যাদব যমুনাতীরে ,
পঞ্চ শরে বিন্ধিয়া শ্রীরাঘব হিয়া
গৃহেতে আসিবে ফিরে।
এরপরে -
ল্যাজেতে খেলাইবো রে -
মদনমোহন কৃষ্ণেরে
ল্যাজেতে খেলাইবো রে -
মোদের রাধারানীর তরে
ল্যাজেতে খেলাইবো রে -
যাও যাও সখী মোর নিজবাসে ফিরি
কাল অতি প্রত্যুষে আসিব শিগগিরি
স্বপনে দেখিবে যাহা শয়নে সারিরাত
ফলিবে জেনো তাহা হইলে প্রভাত। "
আখর :
এত বলি সখীগনে বিদায় লইল
পুলকিত মননে নিজ গৃহে যাইল
ভাবের ভাবিনী রাই মনেতে ভাবিল
আজি কত কথা সই সকলে কহিল
ভাবিতে ভাবিতে মনে রোমাঞ্চ ভরিল
কোনোমতে বাটীপানে গিয়া পহুঁছিল।
(অষ্টম অঙ্ক সমাপ্ত)