এক সময় প্রচুর চিঠি লিখতাম, এখন তেমন লেখা হয় না! অনেক দিনের ব্যবধানে লেখা একটি চিঠি আজ সবার সাথে শেয়ার করলাম। কারো ভালো লাগবে, কারো হয়তো লাগবে না। আপনার ভালো না লাগলে এড়িয়ে যেতে পারেন তাতে খুব সম্ভবত কোন সমস্যা হবে না অন্য কারো।
------------- -----------------------
০৫/০৪/২০২০, ২২/১৩/১৪২৬
রোজঃ রবিবার, সকাল০৪ঃ১৪ মিনিট


দৃষ্টির আড়ালে যে তুমি - ০৭,


বিছানার পাশে সদ্য ফোটা থোকা থোকা বেলী; কিযে মিষ্টি  ঘ্রাণ! মন-প্রাণ উতলা করে তোলে। বেশ ঘুম ঘুম ভাব আসছিল, চোখের পাতা জুড়ে নাচছিল ঘুমকণ্যা। হঠাৎ কুকুরের কান্না! কেমন যে সুর করে কাঁদতে শুরু করে দিল। ঘুম দৌড়ে পালাল। বুক কাঁপতে শুরু করল।আহা, ভয় নয়, ভয় নয়। একাইতো থাকি সব সময়। ভয় করবে কেন? আতঙ্ক বুঝলে! মহামারীর আতঙ্কে আতঙ্কিত সারা বিশ্বের মানুষ। ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল ০৩ঃ৩৬ মিনিট,  চাঁদ ঝিমিয়ে পড়েছে। অবিরাম কুকুরের ঘেউঘেউ আর সুর করে কান্নায় কেমন যেন।করে উঠলো মন! দিনের বেলায়ও দরজা খুলি না, কিন্তু এখন এই সময়ে দরজা খুলে বড় টর্চলাইটটা হাতে নিয়ে ছাদে উঠলাম। সিঁড়িতে কামিনী, অলকানন্দা, রঙ্গন, নীল আর সাদা অপরাজিতা, সাদা-বেগুনী সীমফুল, কাঁচা-হলুদ রংয়ের করলা ফুল, সবাই যেন চিন্তিত বিমর্ষ। করোনা যেন ওদেরও ঘাড়ে চেপে বসে আছে।শুধু বেলীর টবটা আমি বিছানার ডান পাশে টেবিলফ্যানের লাগোয়া পিছনে রেখেছি। ওরা পাপড়ি মেলে সুবাস ছড়াচ্ছে। প্রেমে পড়ে গেলাম ওদের। আরে না, না, তোমাকে ভুলব কেন? ভুলতে কি পারি? ফুলকে কে না ভালোবাসে বলো! এই বেলীর মালা তোমার চূড়া খোঁপায় জড়ালে কিযে সুন্দর লাগে তোমাকে!


আজ আবার কি হলো জানো? পোষাক শিল্পের শ্রমিকেরা দেশগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে শুরু করেছে।
গার্মেন্টসে নাকি তাদের কাজ করতে হবে। অবাক লাগল বিষয়টি। মানুষের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দলবদ্ধভাবে চলাফেরা নিষিদ্ধ করে নিরাপদ দূরত্বে থাকার নির্দেশ জারি করে যেখানে সরকারী সকল অফিস আদালত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সকল প্রকার জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে কি করে যে এই সিদ্ধান্ত নিলেন কর্তৃপক্ষ তা বোধগম্য নয়। আসলে কে ভাল চায় আর কে চায় না তা বুঝা দায়। সবাই মুখোশধারী। আসল মতলব বুঝা মুস্কিল। যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাতে যারা সায় দিয়েছে উভয়েই দেশ ও জনতার কথা ভাবে না। স্বার্থ নিয়ে মগ্ন থাকে। এদের জবাবদিহিতারহ আওতায় আনা খুবই আবশ্যক।  দেশের ক্রান্তিলগ্নেই দেশদরদী চেনা যায় খুব সহজে।


আজ আর বোধ হয় ঘুম হবে না। এখন প্রতিদিন সকালে উঠতে দেরী হচ্ছে। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না। ভাবছিলাম তোমাকে বলব সকালে ডেকে দিতে। কিন্তু বলা হয়নি ভুলে গেছি। আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যাই খুব সহজে। মোবাইলে এলার্ম দেওয়া আছে প্রতিদিন সকাল ৬ টায়, তাতে কি হবে, বেঁজে বেঁজে বন্ধ হয়ে যায় আমার ঘুম ভাঙ্গার কোন খবর নাই। এমন চলতে থাকলে অচিরেই শরীরের বারোটা বাজবে। কি করবো বলো।


আজ 'টুনটুনি' শিরোনামে একটি কবিতা লিখলাম। তাদের ছবিও কবিতার সাথে ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছি। আজই পাখীটার জন্য আড়াই লিটারের কোকের বোতল কেটে একিটা সুন্দর বাসা বানিয়েছি, বাসাটা ও দেখেছে। একবার ভিতরে ঢুকে আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। সারাদিন আর আসেনি। এখন এই চিঠি লেখার সময় কোথা থেকে উড়ে এসে দরজার গ্রিলে বসে মিষ্টি সুর করে ডাকাডাকি করে চলছে একমনে।


রাত বুঝি শেষই হলো। ভোরের আযান দিচ্ছে। উঠে পড়লাম। খুব ইচ্ছে হলো একটু ছাদে যেতে। টবের গাছগুলো সারারাত শিশিরের ছোঁয়া পেয়ে কিযে সতেজ হিয়ে উঠেছে! অনেক ভালো লাগছে দেখতে, চোখ জুড়িয়ে যায়। আবার নিচে এসে পানির বড় মগটা নিয়ে গেলাম। সবগুলো টবে পানি দিলাম। ক্রমে ক্রমে আকাশ অনেক ফর্সা হয়ে উঠেছে। সারারাত কান্নাকাটি আর ঘেউঘেউ করা কুকুরগুলোও বোধ হয় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তার পাশেই। চোখ জ্বালাপোড়া করছে, একটু শোব। দেখি একটু ঘুমাতে পারি কি না! নিয়ম মেনে চলার কারনে যতটুকু সুস্থ মনে হয় নিজেকে, একটু অনিয়ম বা উনিশ-বিশে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ি নিমিষেই।  


কালের গর্ভে যে সময়গুলো আমাদের হারিয়ে গেলো ও আর কোনদিন ফিরে আসবে না। অথচ কত প্রত্যাশা বুকে বয়ে বেড়াই। আমাদের এলাকায় শুনেছি রেললাইন চালু হয়েছে। মাঝে মাঝে কি উদ্ভট চিন্তা আসে মাথায়। খুব ভাবি কবে যেন কবিগুরুর 'হঠাৎ দেখা'র মত আমাদের দেখা হয়ে যাবে রেলের কামরায়। বরের পাশে বসে বই পড়বে। হয়তো চিনতে পারবে, গোপন দৃষ্টিতে দেখবে, বলবে না কিছুই। কোন কিছু না বুঝে,  না জেনে নেমে যাবো পরের স্টেশনে।  কি সব অবান্তর চিন্তা ভাবনা তাই না!


এই যে অদৃশ্য তোমাকে নিয়ে এই পত্রাবলী এরই বা কি মূল্য! কে জানবে এ সব? এই এক অতৃপ্ত আত্মার আত্মবিলাপ হয়তো একদিন অনাদরে অবহেলায় হয়ে যাবে চানাচুর বিক্রেতার দোকানের ঠোঙ্গা। সোমত্ত নাতনী-পুতনীরা হয়তো স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরবার পথে চানাচুর বা বাদাম কিনে খেতে খেতে ঠোঙ্গার গায়ের লেখা পড়বে। তোমাকেও বলবে দেখ দিদা দেখ, মনে হচ্ছে কোন এক ব্যর্থ প্রেমিকের বুকচেরা কান্না। হয়ত দেখতে দেখতে তোমারও চোখ ছলছল করে উঠবে। ওরা অবাক হবে কিন্তু কেউ জানবে না এ করুন কাহিনী। পারবে কি ওদের কাছে বলতে! হয়তো পারবে, হয়তো বা না।


ছেলেরা দু'জনেই তোমার কথা জানে। ওদের মা বলেছে, আমি নিজেও বলেছি। ওরাই আমার স্বজন, বন্ধুও বটে! ওদের মা তোমার সব চিঠি পড়েছে, চুলোয় পুড়িয়ে ভাতও রান্না করে খেয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে ওইগুলো দিয়ে একটা বই প্রকাশ করার। তা আর হলো না। মেয়েদের কাছে মেয়েরা যে এতটা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে,  এতটা অসহ্য হয়ে ওঠে তা ঠিক এতটা গভীরভাবে এর আগে মাথায় আসেনি, ভাবতেও পারিনি। ধন্য মাতৃজাতি। এইসব মায়ের গর্ভে যাদের জন্ম তারা কতটা সহনশীল হতে পারে সে বিষয়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত সন্দিহান থেকেই গেল। সন্তানের রক্তে মাতৃগুনাগুণই বেশী স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে কারন মায়ের রক্ত পান করেই ওদের বেড়ে ওঠা এবং প্রতিটি  সন্তানের কাছে পিতার চেয়ে মায়ের শ্রেষ্ঠত্বটা বেশী। যে নারী আজন্ম দেবীর দৃষ্টিতে পুজা করেছি তাদেরকেই এখন বিস্বাস করতে ভয় হয়।


যদি মহামারীতে মারা যাই; কোনদিন যদি আর দেখা না হয়, অতৃপ্ত এই আত্মার হাহাকার ধ্বনিত হবে কোকিল, বউ কথা কও, কুটুম আয়, দোয়েল, শ্যামা, ফিঙ্গে, বুলবুলি, টুনটুনি,  চড়ুই, শালিক, ঘুঘু, কবুতর,  টিয়া, ময়না টিকটিকির কণ্ঠে। পরজন্মে তোমার বাড়ীর পাশে নদীর জল হয়ে জন্মাব। জন্মে জন্মে এক এক রূপ নিয়ে আসব। গোলাপ, বেলী, জুঁই,  চামেলী, কামিনী, অলকানন্দা, রজনীগন্ধা, গন্ধ্রাজ, কাঁঠালচাঁপা,  হাসনুহেনা, নীল/সাদা অপরাজিতা হয়ে সাজাব তোমার বুকের বাগান। জানালা খুলে দিও,  ভোরের আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ব বিছানায় একান্ত সান্নিধ্যে।  শীতের রাতে শিমুলতুলো হয়ে লেপের নীচে জড়াব তোমাকে। কাঁচল হবো আঁচলতলে, ডিম লাইট শোবার ঘরে। ঘামে-গন্ধে, সোহাগে-আদরে জড়িয়ে থাকব বুকের ভাঁজে, শরীরের বাঁকে বাঁকে। কি করে ভুলবে বলো, সোহাগী হাতের ছোঁয়া, ঠোঁটের স্পর্শ,  চুমুর স্বাদ, আলিঙ্গণের শিহরণ। মুখে বললেই মন থেকে ভুলা যায় না সব। আমিও পারিনি। নীরবে কষ্ট সয়েছি। কেঁদেছিও বহুবার,- এ কান্না কেউ দেখে না, কেউ বুঝে না। বুঝে না বিরহের নীরব ক্ষরণ!


যোহরের আযান দিচ্ছে মসজিদে। ক্ষুধা পেয়েছে। রান্না করা নাই কিছু। দেখি কিছু তৈরী করতে পারি কিনা! রান্না করে দেবার মতো তো আর কেউ নেই। নিজেই যা পারি তাই করে নিতে হয়। এবার তাহলে উঠি? ভাল থাকা হয় যেন। অনেক অনেক আদর আর একগুচ্ছ চুমু তোমার জন্য।


ইতি
০৯/০৪/২০২০, ২৬/১২/১৪২৬
বৃহস্পতিবার,  দুপুরঃ০১ঃ১৮ মিনিট, (+৬)