খাতুনে জান্নাত
.................................................
মধ্যযুগীয় সাহিত্যধারার কাল পার হয়ে দীর্ঘদিন বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কবিতা বন্ধ্যাত্বতার কবলে ছিল। বহিরাগতদের শাসনে ও শোষণে নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হয়ে পড়ছিল রাহুগ্রস্ত ও জীর্ণশীর্ণ। সে অন্ধকার সময়ে সম্পূর্ণ তেজস্বিতা, শিক্ষা, জ্ঞান, মনন ও মণীষার সমন্বয়ে আত্মপোলদ্ধির উন্মেষ ঘটে যার হাত ধরে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-১৮৭৩)। হঠাৎই বাংলা কবিতা সেজে উঠে অপরূপ সুষমায়। তিনি কবিতার শুধু ভিত্তি নয় তৈরি করেছেন সাহিত্যের সুরম্য আকাশচুম্বী অট্টালিকা যা শত বছর পরও সুদৃঢ়, সুউচ্চ ও সুসজ্জিত...
.
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪। যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী কেশবপুর থানাধীন সাগরদাঁড়ি গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটা হলেও অনেকের মতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তালা উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। তিনি রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথম পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের খ্যাতনামা উকিল।
.
সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল বাহিত হয়। এ মহামণীষীর বাল্যকালেই প্রোথিত হয় উচ্চ শিক্ষায় আরোহণের অন্যতম শিক্ষন পদ্ধতি। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা মা জাহ্নবী দেবীর কাছে; রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হক প্রাথমিক শিক্ষাগুরু। বিদ্বান ইমামের কাছে মধু শিখেন বাংলা, ফারসি ও আরবি; জ্ঞানলাভ করেন সংস্কৃত ভাষাতেও। পরবর্তীতে তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলেগু, তামিলসহ মোট তেরোটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন । সাহিত্য ও ব্যক্তি জীবনে এক অনন্য বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অসাধারণ প্রতিভাধর এ মহাকবি ভালোবাসতেন দেশ ও মাটি, শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জীবন। তাঁর মধ্যে প্রোথিত ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপ্ত বীজ। তাই তো হয়েছিলেন ধর্মান্তরিত এবং দেশান্তরিতও।
তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তদানীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র মধুসূদন অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এ ছাড়া কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে বদ্ধমূল হলে ১৮৪৩ সালে ভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট খৃষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ‘ওল্ড মিশন চার্চ’ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিতকারী পাদ্রী ডিলট্রির দেয়া মাইকেল নামসহ পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে। তাঁর এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক বিপরীত ধারার আলোড়ন তোলে। রাজনারায়ণ দত্ত বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলে মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। বিশপস কলেজ পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করে। বিশপস কলেজে  অধ্যয়ন শেষ করে কলকাতায় চাকরির চেষ্টা ব্যর্থ হলে তাঁর  মাদ্রাজী বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান। কথিত আছে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন।
.
নানা চড়াই উৎরাই ও ঘাত প্রতিঘাতের চরমতার ভেতরে প্রবাহিত তাঁর কর্ম-জীবন। স্থানীয় খ্রীষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় একটি স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে  শিক্ষকতা করেন। এ-সময় তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। তিনি Eurasion (পরে Eastern Guardian), Madras Circulator and General Chronicle ও Hindu Chronicle পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং Madras Spectator-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন (১৮৪৮-১৮৫৬) ও  Timothy Penpoem ছদ্মনামে কবিতা প্রকাশ ও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Captive Ladie (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ Visions of the Past প্রকাশিত হয়। পঁচিশ বছর বয়সে কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
নিজেকে নিংড়ে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, আত্মসিদ্ধি, প্রেম ও মননশৈলী দ্বারা। তাই তো হলেন বাংলার জাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, নাট্যকার, প্রহসনকার  হিসেবে স্বমহিমায়, স্বকীয়তায়, সুপ্রতিষ্ঠিত। একদিকে কবিতার গাঠনিক বিন্যাস সংবদ্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে কবিতাকে করেন শিল্পবদ্ধ ও মানবিক যা তাকে যুগ, শতাব্দী ও কালের ঊর্ধ্বে রেখেছে । করেছে আধুনিক কবিতার প্রথম সার্থক কবি হিসাবে অনুস্মরণীয়।
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিয়ে করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়। তাঁদের দু জনের  দুই পুত্র ও দুই কন্যা। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসী নাগরিকের  সাথে বিবাহ হয়। তিনি কবির সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। এদিকে মাইকেল তাঁর এক কপি ‘The Captive Ladie’ বন্ধু গৌরদাস বসাককে উপহার পাঠালে গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন একা।
.
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত 'রত্নাবলী' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা' নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'। মধুসূদনের রচনা নতুনত্বের বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ ও রূপ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগে সার্থক সাহিত্যিক। তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয় ও ভাবগত আড়ষ্টতা কাটিয়ে, মধুসূদন ভাষা ও, অলঙ্কার প্রয়োগে সাহিত্যের মান বৃদ্ধি ও বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৬০ সালে তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন ‘পদ্মাবতী‘ নাটক। এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম । বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারের সফলতা তাঁকে উৎসাহিত করে এবং একই ছন্দে একই বছর রচনা করেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। পরের বছর ১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে একই ছন্দে রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি- বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। তাঁর ‘মেঘনাদবদ কাব্য’ এতই শিল্প-সম্মত যে আধুনিক আলোচকগণকে বিস্ময়াভিভূত করে। এই কাব্যের মাধ্যমেই তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মধুসূদন ছিলেন মানবিক কবি। পুরাণ কাহিনীর অসুরকে তিনি মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ যেমন করেছিলেন তেমন বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য ও আরও অনেক নাটক ও লেখায় নারীর অধিকার ও নারীকে সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশরূপে বিধৃত করেছেন যা সে সমাজ বাস্তবতার পরিপন্থী ছিল। তাঁর কাব্যে নারীবিদ্রোহের সুর লক্ষণীয়। কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত, আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে জেগে ওঠে। তারা নিজেদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ এবং কামনা-বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। এখানে জনা, কৈকেয়ী প্রমুখ পৌরাণিক নারী তাদের স্বামী বা প্রেমিকদের নিকট নিজেদের কামনা-বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করে। নারীচরিত্রে এরূপ দৃঢ়তার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে প্রত্যক্ষ করা যায় না। তিনি ছিলেন সাহসী, স্বতঃপ্রণোদিত মানবিক ও জীবনের সঠিক চলমানতার দক্ষ চিত্রকর। মধুসূদনের এ সময়কার অপর দুটি রচনা হলো 'কৃষ্ণকুমারী' (১৮৬১) ও ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১)। প্রথমটি রাজপুত উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক এবং দ্বিতীয়টি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য। এ পর্বে মধুসূদন দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং কিছুদিন হিন্দু প্যাট্রিয়ট (১৮৬২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
.
১৮৬২ সালের ৯ জুন মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন। বিলেতের আবহাওয়া ও বর্ণবিদ্বেষীতার কারণে ১৮৬৩ সালে প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে প্রায় দু’বছর অবস্থান করেন। ভার্সাইতে অবস্থানকালে তাঁর জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এখানে বসেই তিনি ইতালীর কবি পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট বা চতূর্দশপদী কবিতা লিখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষায় এটিও এক বিস্ময়কর নতুন সৃষ্টি। এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিল না। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ভার্সাই নগরী তাঁর মনে স্বদেশ ও স্ব ভাষার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করে। যার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ সনেটে। তাঁর এই সনেটগুলি ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’(১৮৬৬) নামে প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। অমৃতাক্ষর ছন্দ হলো অন্তমিল হীন কাব্যরূপ।  ‘মেঘনাদবধ  কাব্য’র ষষ্ঠ সর্গের অংশ বিশেষ যা “মেঘনাদ ও বিভীষণ” নামে পরিচিত তা নিম্নরূপ-
“এতক্ষণে --অরিন্দম কহিলা বিষাদে
জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ? --শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,’
ভার্সাই নগরীতে দু বছর থাকার পর মধুসূদন ১৮৬৫ সালে পুনরায় ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৬৬ সালে গ্রেজ-ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর সহায়তায় আর্থিক সংকট নিরসনে ব্যারিস্টারি পাশ করে ভারতে আসতে সক্ষম হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে নিয়ে তিনি একটি চতূর্দশপদী কবিতা লিখেছেন…
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্দু তুমি, সেই জনে মনে,
দীন যে দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রীর হেম-ক্লান্তি –অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যেজন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জনে কতগুণ ধরে কত মতে
গিরীশ কী সেবা তার সুখ সদনেু
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিংকরী
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ শীরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি।
পরিমলে ফুল-কুল দশ-দিশ ভরে,
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।
১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে  যোগ দেন। কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পেরে ১৮৭০ সালের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। দু বছর পর এ চাকরি ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবারে তিনি সফল হন, কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অমিতব্যয়িতার ব্যাপারটি ছিল তাঁর স্বভাবগত। ১৮৭২ সালে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর ম্যানেজার ছিলেন। জীবনের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মধুসূদন কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে ১৮৭১ সালে রচনা করেন ‘হেক্টরবধ’। তাঁর শেষ রচনা মায়াকানন(১৮৭৩) নাটক। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর ১২টি এবং ইংরেজি ভাষায় ৫টি মোট ১৭টি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের ধারার  সমকালীন সুশিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির উপযোগী কাব্যরচনা করেন। তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বিয়োগান্ত নাটকের মতো গভীর বেদনাঘন। আর এ বেদনা ও জীবনের পট পরিবর্তন তাঁকে নিবিষ্ট করেছে সাহিত্যের পথে। ঊনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মধুসূদন অনন্য প্রতিভায় বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ করেন, তাই তো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও বর্তমানে তিনি অমর ও অনুস্মরণীয় চিরদিন, চির অম্লান।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিনদিন পর কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এ অমরস্রষ্টা মাত্র ৪৯ বছর বয়সে।
মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তাঁর সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে :

'দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'