প্রচণ্ড শীতের এক সকালে, পাহাড়ের পাদদেশে
আগুনের চারিদিকে একটি পরিবার বসে এসে।
লাজুক সূর্যটা উঠেও বার বার মুখ লুকায়
পাহাড়ী ঘরটার সমুখে তাই তারা আগুন পোহায়।


বাবা ও মায়ের মুখে মাপা মাপা সুখ
অষ্টাদশী কন্যাটি আগামীর স্বপ্নে উত্সুক।
বয়োবৃদ্ধা দাদীর সুখ উলের বুননে
আর অতীতের কথাগুলো বারবার শুননে।


প্রচণ্ড শীতে যে আগুন কমায় দেহের কাঁপন
পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অচিন যুবককে করে নেয় আপন।
বৃত্তের মাঝখানে জায়গা করে ঢোকে
যুবকের চোখ পড়ে অষ্টাদশীর চোখে।
তৃপ্তির শব্দ ওঠে মুখে - আহ কী সুখের গরম!
সবার অলক্ষ্যে অষ্টাদশীর চোখে খেলে শরম।


বাবা শুধায়, তুমি যাবে কি অনেক দূরে?
যুবক উত্তর দেয়, অদৃষ্টের সন্ধানে যাবো স্বপ্নপুরে।
সহসা সকলের সজাগ দৃষ্টি পড়ে পাহাড়ের চূড়ায়,
ছোট্ট একখণ্ড পাথর নিচের দিকে গড়ায়।
বাবা বলে কৌতুকে, বৃদ্ধ এই পাহাড়
যখনই ভুলি তারে পাথর ছুড়ে দেয় চিতকার।
তারপর শান্ত হয় রাগ নিঃশেষী
এভাবেই যুগ যুগ আমরা প্রতিবেশী।
হয়তো ও-ই হবে একদিন আমাদের মৃত্যুর কারণ
তুমি সমতলের যুবক, তাই এ পথে চলতে করি বারণ।


তাচ্ছিল্যে যুবক বলে, আরে মরবো না অতো অল্পে
আমার নামই তো জানোনি এখনও আজকের গল্পে।
যে নাম একদিন উঠবে কাব্য-গানে খ্যাতির শিখরে
আর লেখা রবে সমাধি ফলকে মৃত্যুর পরে।
যে ফলকের পাশে এসে পথিক থামবে দুদন্ড
পড়ে যাবে এ কবির লেখা কয়েকটি ছন্দ।


বাবা, মা, দাদী আর সেই অষ্টাদশী মেয়ে
কিছুক্ষণ থাকে সেই যুবকের মুখ পানে চেয়ে।
হয়তো বা বোঝে না তারা তার সব কথা
বোঝে না তার স্বপ্নময় চোখের চপলতা।
হয়তো বা অষ্টাদশী সবার অজান্তেই ভাবে
তোয়াক্কাহীন এই পথিকের সাথেই একদিন সে হারাবে।
অতপর বলে নম্র স্বরে
অতো উচ্চ চিন্তা নেই পাহাড়ের নিচে থাকা অন্তরে।
দিন আনি, দিন খাই, কেটে যায় দিন
মৃত্যুর পরেও আমাদের সমাধি রবে নামহীন।
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় বস্ত্রহীন কাঁপে এই বুক
সকালে আগুনের তাপে পায় স্বর্গের সুখ।


সহসা পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রচণ্ড বড় এক পাথর
বিকট শব্দে নিচে গড়ায়, পাহাড়টা কাঁপে থরথর।
বাবা, মা, দাদী, অষ্টাদশী, যুবক-পথিক
প্রাণভয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে ছোটে দুইদিক।
পাথরটা মাঝপথে ধাক্কা খায় আর একটা পাথরে
ভাগ হয় পাঁচখণ্ডে - দুইদলে নামে তারপরে।
পাহাড়ী ঘরটা রয় অক্ষত মাঝখানে
পাঁচটা দেহের উপর পাঁচটা খণ্ড বসে স্থায়ী অবস্থানে।


কালের গহবরে দীর্ঘ সময় হয়েছে বিলীন
সংরক্ষিত ঘরটি আজো পাহাড়ের গায়ে আছে অমলিন।
চারটি পাথরখণ্ডে লেখা আছে চারজনের নাম
আজও ভ্রমণকারী যা দর্শনে যায় অবিরাম।
এক পাহাড়ী কবির ছন্দে লেখা আছে গান
অজস্র পাহাড়ী মানুষের কণ্ঠে ওঠে তার সুর-তান।
পাথরে-অন্তরে টিকে আছে চারজনের সমাধি-ফলক
কারো জানা নেই সেখানে ছিল আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক।
তার দেখা স্বপ্ন কোনদিন হয়নি পূরণ
অথচ হয়েছে তা, যারা দেখেনি সে স্বপন।


কে বোঝে জগতে কূহকের রহস্য?
যে চায় সোনার ফসল, সে পায় ভস্ম!
যে পায়, সেও জানে না কী সে পেলো,
কে করে তা ঠিক? না করে এলোমেলো?
স্বপ্নময় মানুষের মন তবু স্বপ্ন দেখে যায়
অনন্ত সময় আপন খেয়ালে চিত্র এঁকে যায়!