।ছড়া নিয়ে মজার কথা।


আঠারো/ঊনিশ বছর আগে, একদিন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরব। এমন সময় প্রণবদা (প্রণব মোদক) ও আমাকে মনাদা (কবি মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়) বললেন, 'আমার গাড়িতে চলো।' আমাকে দমদমে ও প্রণবদাকে নাগেরবাজারের মতিঝিলে নামিয়ে দিয়ে মনাদা তাঁর দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে ফিরবেন। দু-চারজনের সঙ্গে একথা সেকথার পরে, আমরা দু-জন মনাদার গাড়িতে সওয়ারি হয়ে বাড়ির পথ ধরি।


মনাদা কবি, গল্পকার ও  প্রাবন্ধিক। বাংলা ও ইংরেজিতে এম এ মনাদা শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। সেদিন আমাদের যাত্রাপথে গাড়ি শ্যামবাজার এ ভি স্কুল আসার সামান্য আগে মনাদা বললেন, 'জানো, বাগবাজার স্ট্রিটে ভালো চন্দ্রপুলি পাওয়া যায়। এ ভি স্কুলে পড়ানোর সময়, মাঝেমধ্যেই আমরা পিওনকে দিয়ে চন্দ্রপুলি আনিয়ে খেতাম।' চন্দ্রপুলির নাম শুনেই আমার জিভে জল এসে গিয়েছিল। মনাদার মুখে চন্দ্রপুলি খাওয়ার কথা শুনে জিভ থেকে জল ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল। মুহূর্তে আমার মুখ থেকে একটা দু-লাইনের ছড়া বেরিয়ে এল। ছড়াটা এই রকম, 'বাগবাজারের চন্দ্রপুলি,/ আমরা খাব অনেকগুলি।' ছড়াটা শুনে প্রণবদা সহর্ষে 'দারুণ! দারুণ!' বলে হাততালি দিয়ে উঠলেন। আর মনাদা ড্রাইভারকে বললেন, 'বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে।' মনাদার কথামতো গাড়ি বাগবাজার স্ট্রিট ধরে এগিয়ে মনাদার নির্দেশে একটা জায়গায় থামল। মনাদা ড্রাইভারকে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে তাঁর পছন্দের দোকান থেকে চন্দ্রপুলি আনালেন। গাড়িতে বসে জমিয়ে চন্দ্রপুলি খাওয়ার পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে প্রণবদা মন্তব্য করলেন, 'ছড়ার অনেক গুণের কথা আগে শুনলেও, ছড়ার মিষ্টিআনয়নকারী ক্ষমতার কথা জানা ছিল না।'


ছড়াটাকে পরে আমি বিশেষ একটা কাজে ব্যবহার করেছিলাম। শাশুড়িমার স্ট্রোক হওয়ার পরে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়ে আমাদের বাসায় কিছুদিন ছিলেন। স্ট্রোকের জন্য তাঁর কথা কিছুটা জড়িয়ে যেত। ডাক্তারবাবু তাঁকে বিশেষ কয়েকটা শব্দ বারবার বলতে বলেছিলেন। ডাক্তাবাবুর দেওয়া শব্দগুলোর পাশাপাশি, আমি তাঁকে এই ছড়াটা বলতে বলেছিলাম। তিনি দিনে অন্তত দুশোবার ছড়াটা বলতেন। ডাক্তারবাবু তা জানতে পেরে একদিন আমাকে বললেন, 'ইন্টারেস্টিং! ছড়াটা একটা কাগজে লিখে দিনতো, ওটা  অন্য পেশেন্টদেরও প্রেসক্রাইব করব।'


পরের ছড়াটার কেন্দ্রে আমাদের অফিসের সত্যদা। মৃদুভাষী সত্যদার মুখে হাসি সবসময় লেগেই থাকত। একদিন, অফিসের ক্যান্টিনে যাওয়ার সময় দোতলার করিডোরে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হতে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছি। কী হল কে জানে, হঠাৎ আমার মুখ থেকে একটা ছড়ার লাইন বেরিয়ে পড়ল, 'সত্যদাতো মিথ্যা নয়।' শুনে সত্যদার আকর্ণবিস্তৃত অমায়িক হাসি। আমি বললাম, 'দাঁডান, দাঁডান, আগে সবটা শুনে তারপর হাসবেন।'  সত্যদা হাসতে হাসতেই বললেন, 'হ্যাঁ, পুরোটা বলো।' আমি তখন দু-লাইনের পুরো ছড়াটা বললাম, 'সত্যদাতো মিথ্যা নয়,/ এই কথাটা সত্য নয়।' দ্বিতীয় লাইনটা শুনে সত্যদার হাসি মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। আমাকে বললেন, 'তুমি মহা বিচ্ছু!' আমি বললাম, 'সত্যদা, এটাতো একটা ছড়া মাত্র, এটাকে সিরিয়াসলি নেবেন না।' বললে কী হবে, সত্যদা আমার কথা কিছুতেই মানবেন না। তিনি সমানে বলে গেলেন, 'তুমি মহা বিচ্ছু! তুমি মহা বিচ্ছু!'


সত্যদার কথা মনে এলে এখনও এই ছড়াটার কথা মনে পড়ে যায়। মনে মনে তখন প্রতিজ্ঞা করি, সত্যদার সঙ্গে দেখা হলে কিছুতেই আর এই ছড়াটা বলব না।


অরি মিত্র