'বেণীমাধব' (জয় গোস্বামীর 'মাধবীবালা বালিকা বিদ্যালয়' কবিতা অবলম্বনে), 'সাঁকোটা দুলছে' (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), 'আবার আসিব ফিরে' (জীবনানন্দ দাশ), 'যমুনাবতী', 'মনে হয় অনেক দিনেই' (শঙ্খ ঘোষ), 'আমরা তো অল্পেই খুশি' (জয় গোস্বামী) ও আরো অনেক আধুনিক বাংলা কবিতা সুরারোপিত হয়ে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের গলায় গান হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ার নেপথ্য কারিগর বিশিষ্ট সুরকার, গীতিকার ও নাট্যশিল্পী সমীর চট্টোপাধ্যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ৩১ অগাস্ট সকালে কলকাতার রুবি হাসপাতালে প্রয়াত হন। আশি ছুঁইছুঁই এই শিল্পীর প্রয়াণ বাংলা গানের জগতের পক্ষে এক বড়ো ক্ষতি। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান, পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান শিল্পী। সংগীতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই সরল প্রকৃতির মানুষটি সব সময় নিজেকে মিডিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। ফলে, একটা নির্দিষ্ট বৃত্তের বাইরে তাঁর কথা সেভাবেই লোকে জানতেই পারেননি। তাঁর কথা দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে ও খবরের কাগজে যেটুকু এসেছে তার প্রায় সবটাই এসেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে দেওয়া লোপামুদ্রার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এরকমই একটা সাক্ষাৎকারে লোপামুদ্রা বলেছেন, 'ক্লাস এইট অবধি অন্য কোনও গান গাওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি। তারপর আলাপ হল বাবার সহকর্মী সমীর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যাঁকে কাকা বলি। তারপর থেকেই আমার চিন্তাভাবনা, দর্শন, গান গাওয়া, সবটাই বদলে গেল।'
সমীর চট্টোপাধ্যায় গোড়ার দিকে সুরকার হিসেবেই কাজ করতেন। অনেক পরে তিনি গান লিখতে শুরু করেন। 'হেই গো মা দুর্গা' দিয়ে তাঁর গান লেখার যাত্রা শুর। তারপর অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন।
নাটকেও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। নাটকে গান বা কবিতার কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব যেমন সামলাতেন, তেমনি অভিনয়ও করতেন। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি অনেক পথনাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন।
কর্মজীবনে ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কলকাতার কর্মী। ১৯৬৪ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি খেলোয়াড় হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেটে তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটি 'ব্লু' ছিলেন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নেন।
১৯৯৯ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ স্পোর্টস ক্লাব, কলকাতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাঁকে একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি নীচের গানটি লেখেন ও তাতে সুরারোপ করেন।
ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস
ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস,
ও ছেলেরা খেলা ফেলে
শুধুই কেন পড়তে যাস।
এই কি তোদের চাওয়া নাকি
ভর করেছে কালের ভূত,
ভূতের পাওয়া ছেলের দল
কেবল বড়ই হবি খুব।
ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস
ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস,
ও ছেলেরা খেলা ফেলে
শুধুই কেন পড়তে যাস।
সব হারিয়ে কেবল বড়
মাথা যাবে আকাশ ফুঁড়ে,
দেখবি না তো শিশির কেমন
ভোরের ঘাসে খেলা করে।
আয় রে ছেলে আয় রে মেয়ে
আয় রে ছেলে আয় রে মেয়ে,
আয় রে বুড়ো ধাড়ির দল
ছোটার যুগে ছুটবি যখন
মাঠেও না হয় ছুটি চল।
ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস
ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস,
ও ছেলেরা খেলা ফেলে
শুধুই কেন পড়তে যাস।
ছক কাটা এই ছকের শহর
ছকে বাঁধা ছকের জীবন
কুলোর বাতাস বলতে তো এই
একটু সবুজ যখের ধন।
ও ছেলেরা ও মেয়েরা,
ও ছেলেরা ও মেয়েরা
দেশের দশের চোখের মণি,
কাদা ধুলো মেখে মাঠে,
সবুজ হ না একটুখানি,
সবুজ হ না একটুখানি।
ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস
ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস,
ও ছেলেরা পড়া ছেড়ে
শুধুই কেন পড়তে যাস….
তাঁর পরিচালনায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ স্পোর্টস ক্লাব, কলকাতার সাংস্কৃতিক শাখার শিল্পীরা এই গানটি গেয়ে উপস্থিত সকলের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। এইভাবেই একটি বিখ্যাত বাংলা গানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে গানটি শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের গলায় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্মী সংগঠনের অন্যতম সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা ছিলেন।
চাঁদুদা গানের পাশাপাশি অনেক কবিতাও লিখেছেন। দুঃখের বিষয়, তিনি তাঁর কোনও কবিতাই প্রকাশ করেননি, প্রকাশ করতে দেননি। এমনও হয়েছে, তাঁর কবিতার বই প্রকাশের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে, প্রচ্ছদ পর্যন্ত তৈরি-- একেবারে শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলেন তিনি। সবাইকে হতাশ করে দিয়ে তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গীতে বলে উঠলেন, 'ধুর! কী হবে এই সব করে!' চাঁদুদার কবিতাগুলো বই হয়ে বেরোলে, বাংলা কবিতার পাঠকেরা উপকৃত হবেন। আশা করা যায়, চাঁদুদার শুভানুধ্যায়ী ও প্রিয়জনেরা তাঁর কবিতার খাতাগুলোকে প্রকাশের আলোতে নিয়ে আসবেন।
শিল্পীর মৃত্যু হয় না। সমীর চট্টোপাধ্যায়ের গানই তাঁকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে।
ছবি: সোমেন ভৌমিকের সৌজন্যে।