।কবি কৃষ্ণ ধর।


বিশিষ্ট কবি কৃষ্ণ ধর সম্ভবত এই মুহূর্তে দুই বাংলার প্রবীণতম কবি। সম্ভবত বলা হল এই কারণে যে, এটা বলা সত্যিই মুশকিল, তাঁরও আগে জন্মেছেন এমন কোনো কবি (যিনি তত পরিচিত নন) পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ  অঞ্চলে এখনো জীবিত আছেন কিনা।


1928 সালে অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার কমলপুর গ্রামে কৃষ্ণ ধরের জন্ম। বাবার নাম উপেন্দ্রচন্দ্র ধর ও মায়ের নাম চিন্ময়ী দেবী। বাজিতপুর এইচ ই হাই স্কুল থেকে 1943 সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফেনী কলেজ থেকে 1945 সালে আই এ পাশ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে 1947 সালে অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এম এ পড়েন। এম এ পড়তে পড়তেই 1948 সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অঙ্গীকার' প্রকাশিত হয়। তখনকার বিখ্যাত 'চতুরঙ্গ' পত্রিকায় এই কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। 1949 সালে কবি এম এ পাশ করেন।


তাঁর কর্মজীবনের শুরু কলকাতা দেশবন্ধু গার্লস কলেজে অধ্যাপনা  দিয়ে। অল্পদিন সেখানে পড়ানোর পরে তিনি 'যুগান্তর' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি 'যুগান্তর'-এর সম্পাদক হন। বিশিষ্ট সাংবাদিক কৃষ্ণ ধর বিভিন্ন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও ভারতীয় বিদ্যা ভবনের সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। 1990 থেকে 1992 পর্যন্ত তিনি 'বসুমতী' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।


কৃষ্ণদা গত শতাব্দীর পাঁচের ও ছয়ের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। ওই সময়কালের মধ্যে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল 'প্রথম ধরেছে কলি', 'এ জন্মের নায়ক', 'এক রাত্রির জন্য', 'আমার হাতে রক্ত', 'কালের নিসর্গ দৃশ্য', 'দুঃসময় কবিতার লেখকের কাছে' প্রভৃতি। পরবর্তী কালে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আছে 'কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম', 'যে যেখানে আছো', 'শব্দহীন শোভাযাত্রা', 'হে সময় সন্ধিক্ষণ', 'নির্বাচিত কবিতা', 'প্রিয় বাক্ কথা রাখো', 'গাঙচিলের স্বপ্ন ও সাতরঙা রামধনু', 'হাঁটব থামব না', 'শ্রেষ্ঠ কবিতা', 'কবিতা সংগ্রহ' প্রভৃতি।


কবিতার পাশাপাশি তিনি অনেক কাব্যনাটক রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যনাটকগুলি হল 'কালের নিসর্গ দৃশ্য', 'পদধ্বনি পলাতক', 'নির্বাচিত কাব্যনাটক', 'বনজ্যোৎস্না ও সমবেত করতালি', 'বিরুদ্ধ বাতাস' 'পায়ের শব্দ শোনা যায়', 'কাব্যনাট্য সংগ্রহ' প্রভৃতি।


তাঁর লেখা দুটো অত্যন্ত সুখপাঠ্য ভ্রমণকাহিনী হল 'মস্কো থেকে দেখা' ও 'অন্য দেশ অন্য নগর'।


আজ থেকে চার বছর আগে বেরিয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণামূলক লেখা 'আট দশক সাত কাহন'। গত বছর 'ঝাঁকিদর্শন' শিরোনামে তাঁর  আর একটা স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হয়েছে। দুটোই বেশ সুখপাঠ্য।


সাহিত্য নিয়ে লেখা তাঁর বইয়ের মধ্যে আছে 'আধুনিক কবিতার উৎস' ও 'সাহিত্যের সাজঘর'।


তাঁর ইতিহাসমূলক লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ', 'ভারতের মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি' ও 'কলকাতা তিন শতক'।


সাংবাদিকতা নিয়ে লিখেছেন 'সাংবাদিকতার দর্শন: আদর্শ ও বিচ্যুতি'।


এ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের ওপর তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'বই পড়ুয়ার দেখা মানুষ', ও 'পুরানো আখরগুলি'।


কৃষ্ণদার কবিতার ভাষা বড়ো মোলায়েম। ব্যক্তি জীবনের মতো কবিতাতেও তিনি মঞ্জুভাষ। অনুচ্চ কণ্ঠে মৃদু পদক্ষেপে তাঁর কবিতা আমাদের অজান্তেই আমাদের নিয়ে চলে যায় তাঁর কবিতার নিজস্ব ভুবনে। কঠোর বাস্তবের লড়াই সংগ্রামের কথা বলার সময়েও কৃষ্ণদা বরাবর অনুত্তেজিত থেকেছেন। তাই তাঁর কবিতা পড়ে পাঠকেরাও অনুত্তেজিত চিত্তে সমকালে তাঁদের কৃত্যাকৃত্য নির্ধারণের দিশা খুঁজে পান। 'হে সময় হে সন্ধিক্ষণ' কাব্যগ্রন্থের নীচের কবিতাটি পড়লেই এটা বুঝতে পারা যাবে।


অশ্বমেধের ঘোড়া


মারহাট্টা ডিচের ওপারে থমকে দাঁড়িয়ে যায়
যত অশ্বমেধের ঘোড়া
এমনি শহর ওরা বানিয়ে রেখেছে।


মহারাজ, তবে আজ তুমিও যজ্ঞের আশা ছাড়ো
ওই দ্যাখো কালিগুলার দামাল ঘোড়াটা
ইতিহাসে পাথর সেজেছে।


এ শহরকে তুমি চেনো না মহারাজ
হাততালি দিলে পিল পিল করে
বেরিয়ে পড়ে অক্ষৌহিণী সেনা
এরা সব সংসপ্তক।
হাজার বছর ধরে মার খেতে খেতে
এ মাটি এখন পাথর
এ বড় কঠিন শহর মহারাজ,
দ্যাখো কী বেইজ্জত, অশ্বমেধের ঘোড়া
ময়দানে গিয়ে মুখ দেয় অর্বাচীন ঘাসে।


কিংবা তাঁর 'কবিতা সংগ্রহ'-এর নীচের কবিতাটি।


সব দিতে পারি


দিতে পারি আমাদের সব গোপন অহংকার
ভাষার মালা গেঁথে অনিঃশেষে
দিতে পারি আমাদের দিন ফুরোবার আশা ও নিরাশা
বিনাশর্তে হলুদ খামেতে পুরে ডাকবাক্সে
দিতে পারি বাহান্ন বিঘার ছায়াবীথির কুসুমবাস
চৈত্র দিনের খ্যাপা হাওয়া বিজন দুপুরে
দিতে পারি ঘাট বাঁধানো পুকুরের শান্ত শীতলতা
তৃষ্ণার্তের প্রহরে অযাচিতে।


দিতে পারি অভিমানী হৃদয়ের মৌনভাষ।
অনিদ্রাকাতর রাত্রির নিঃসঙ্গ মুহূর্তে
দিতে পারি আমাদের নিকানো দাওয়ার আলপনা
মাঘমণ্ডলের ব্রতকথা, আশ্বিনের ঘ্রাণ
দিতে পারি এই জেনে, তোমার শিয়রে ওরা জেগে থেকে
আমাদের শিকড়ে দেবে জল আর রৌদ্রের খবর।


বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ কৃষ্ণ ধরের কবিতা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, 'সুমিত শব্দচয়ন, রূপময় চিত্রকল্প রচনা, এবং সূক্ষ্ম ভাবাবেশ তাঁর কবিতাগুলির প্রধান আকর্ষণ।'


গত কয়েকবছর কবি বার্ধক্যের কারণে ঘরের বাইরে বেরোতে পারতেন না। তাঁর কাছে তাঁর ছোট মেয়ে সুরঞ্জনা চৌধুরি থাকতেন। কিছুদিন আগে অসুস্থতার জন্য তাঁকে কলকাতার একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছিল। সেখানেই গত 12 অক্টোবর 2022, চুরানব্বই বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে, মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই চিকিৎসকেরা তাঁর দুটি চোখ সংগ্রহ করেন। পরের দিন, কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে তাঁর ইচ্ছার প্রতি মর্যাদা জানিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর দেহ দান করা হয়। ভাবতে ভালো লাগছে, কৃষ্ণদা চলে গেলেও তাঁর চোখদুটি রয়ে গেল পৃথিবীর আলো দেখার জন্য।


(অক্টোবর 20, 2022-এ সম্পাদিত)



অরি মিত্র