: Rubaiyat of Omar Khayyam -77:-
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক জনাব আবুল কাইয়ুম,গ্রহণ
করিলেন না আমার হাদিয়ামুক্ত উপহার,
বইমেলা থেকে নিজেই কিনিয়া,করিলেন নিন্মোক্ত নির্মোহ
সমালোচনা,শ্রদ্ধায় মাথা নত হলো আমার।
রচনাকাল:-
ঢাকা২১/১০/১৮
রাত৮-২৫
আবুল কাইয়ুম is with মোহাম্মদ আলী চৌধুরী.
ওমর খৈয়ামের রুবাই-এর অনুবাদ এবং মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’
আবুল কাইয়ুম
বাংলা ভাষায় ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অনুবাদের প্রয়াসটি শতবর্ষীয় বা তার চেয়েও পুরানো। অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিক এই অনুবাদকর্মে সামিল হয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অক্ষয় কুমার বড়াল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম , ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, নরেন্দ্র দেব, হিতেন্দ্রনাথ বসু, শ্যামাপদ চক্রবর্তী, বিমলচন্দ্র ঘোষ, বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, সুধীর গুপ্ত, অশোক ভট্টাচার্য, সুনীলচন্দ্র দত্ত, বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ, সিকান্দার আবু জাফর, শক্তি চট্টোপাধায় এবং আরো অনেকে। অধিকাংশ অনুবাদকই ফিটজেরাল্ডের অনুসরণে রুবাই অনুবাদ করেছেন। তবে মূল ফার্সি থেকে যেসব অনুবাদ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের “রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম” এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর “রুবাইয়্যাত-ই-উমরখয়্যাম” সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, অসংখ্য রথী-মহারথী কর্তৃক বাংলায় ওমর খৈয়ামের একই প্রকার কবিতা এত বিভিন্নভাবে অনুবাদের পরও এই কাজটির আর কোন প্রয়োজন আছে কি না? আছে, কারণ প্রাচীনকে জীবন্ত করার জন্য পরিবর্তিত অবস্থায় এর অনুবাদে আধুনিকতার সঞ্চার ঘটানোর বিষয়টিকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
সমকালের উপযোগী ভাষাতেই ক্লাশিক সাহিত্যের অনুবাদ সমকালীন পাঠকের সাথে অধিকতর কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রসঙ্গে তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “লেখক প্রাচীন বলে তাঁকে বেদীতে বসিয়ে যদি পূজো করতে থাকি তবে তাঁকে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হলো, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিয়ে আমাদেরই ভাষায় কথা বলাতে হবে।” এ যুগের কথাই ধরা যাক, কবিতায় উহার, তাহার, গেনু, ছিনু, করিনু, গুনিয়া, শুনিয়া, রচিয়া, ভেদিয়া, তব, লব, পাশরিয়া, নিরক্ষিয়া, নাশিতে, গাহিতে –এসব এখন মৃতশব্দ। কবিতার ভাষায় শুধু নয়, সব ধরণের সাহিত্যেই সাধুভাষার ব্যবহার উঠে গেছে পাঁচ/ছয় দশক আগে। ভাষাগঠনরীতিও ক্রমশ পাল্টাচ্ছে। তাই তো সময়ের উপযোগী করে রুবাই অনুবাদের তাড়না ছিল সিকান্দার আবু জাফর ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে। কিন্তু দুঃখজনক, আরো সময় পেরিয়ে এখনকার এই প্রমিত বাংলার যুগে ফেসবুকে এবং অন্যত্র ইদানিং যে সকল অনূদিত ও স্বরচিত রুবাই দেখা যায় সেগুলোর অধিকাংশই ভাষাগত আধুনিকতার প্রশ্নে অনেক পেছনে পড়ে আছে।
ফিটজেরাল্ড নিয়েও বিতর্ক। তিনি ওমর খৈয়ামের অনেক রুবাইয়ের বক্তব্য আমূল বদলে দিয়েছিলেন। সেই ফিটজেরাল্ডের ভিত্তিতেই রুবাই অনুবাদ করে কিছু অনুবাদক নান্দনিক পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, যা আলোচ্য অনুবাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বেলাতেও সত্য। তাঁদের সকলেই বিশেষ অন্ত্যমিল প্রক্রিয়াকে ঠিক রেখে অনুবাদ করলেও ভাষা ও মর্মের দিক থেকে রুবাইগুলো আলাদা আলাদা কবিতা হয়ে উঠেছে। ফিটজেরাল্ডের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত অনুবাদ এবং তাঁর ভিত্তিতে বাংলায় অনুবাদের বেলায় গঠনশৈলী ও বোধের ভিন্নতার কারণে পাঠক হিসেবে আমাদেরকে খৈয়াম থেকে একটু ছিটকে পড়তে হয়। কী আর করা, এ ক্ষেত্রে এটা ঘটাই স্বাভাবিক। একেক জনের হাতের রান্না খাওয়ার মতো আমাদেরকে প্রত্যেকের অনূদিত রুবাই থেকে আলাদা আলাদা আস্বাদ সম্ভোগ করেই তৃপ্ত থাকতে হয়। ফিটজেরাল্ড ও অনুবাদকদের সৃষ্ট এই অবস্থাটি অবশ্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে ধরা পড়েছিল। তিনি সরাসরি ফার্সি থেকে বাংলায় রুবাইগুলো অনুবাদ করেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে। আমার জানা মতে, তিনিই কাজী নজরুল ইসলামের পর ওমর খৈয়ামের সবচেয়ে সার্থক অনুবাদক।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী সহ বিভিন্ন জনের দ্বারা খৈয়ামের রুবাইয়ের বাংলা অনুবাদ কীভাবে ক্রমবিবর্তিত হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে দেওয়া হলো (কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)-
কাজী নজরুল ইসলাম মূল ফার্সি থেকে একটি রুবাই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এভাবে-
আমরা দাবার খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই ।
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব
খেলা শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!
এই রুবাইটির এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড অনুবাদ ছিল এরকম-
“Tis all a Chequer-board of nights and days
Where Destiny with men for Pieces plays:
Hither and thither moves, and mates,and slays,
And one by one back in the closet lays.”


কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদ-
ছকটি আঁকা সৃজন ঘরের
রাত্রী দিবা দুই রঙের,
নিয়ৎ দেবী খেলছে পাশা
মানুষ ঘুঁটি সব ঢঙের;
পড়ছে পাশা ধ'রছে পুনঃ,
কাটছে ঘুঁটি, উঠছে ফেরÍ
বাক্সবন্দী সব পুনরায়,


সাঙ্গ হলে খেলার জের।
কান্তি ঘোষ চারটি স্তবককে ভেঙে আটটি স্তবক দেখালেও রুবাইয়ের অন্ত্যমিলের নিয়মটি ঠিক রেখেছেন।
একই রুবাই সিকান্দার আবু জাফরের হাতে যেভাবে অনূদিত হয়েছে-
দিন-রাত্রির রঙ দিয়ে আঁকা দাবার ছকটি মেলে
নসীব খেলছে বিচিত্র খেলা মানুষের ঘুঁটি চেলে;
ঘর থেকে ঘরে চালে চালে ঘুঁটি পড়ছে মরছে আর
দান শেষ হলে আবার তাদের বাক্সে রাখছে ঢেলে।
আর মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনুবাদও সবার মতো ভিন্নতা নিয়েই হাজির হলো-
রাত্রি আর দিনের মতো পাশার ছকের আমরা গুটি
নিয়তিরই ইচ্ছামত ডাইনে বায়ে যাইগো ছুটি।
খেলা তার সাঙ্গ হলে আবার তুলে বাক্সে রাখে,
অনন্ত ঘুম ঘুমাই যেথা, এটাই জীবন মোটামুটি।
সবগুলো অনুবাদই যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ তাতে সন্দেহ নেই। সিকান্দার আবু জাফর শুধু মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন। আর মোহাম্মদ আলী চৌধুরী এই রুবাইটির অনুবাদে পূর্বসূরী নজরুল ও কান্তি ঘোষোর মতো স্বরবৃত্ত ছন্দে বাণীবন্ধ গড়েছেন। শুধু তাঁরাই নন, রুবাইকে দ্রুত লয়ে ঝংকৃত করে উপস্থাপনের জন্য অনেক অনুবাদকই স্বরবৃত্তের কাঠামোকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত তাঁর ‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’ অনুবাদগ্রন্থে যেমন দেখা যায়, গদ্যভাষিক পংক্তিতে অন্ত্যমিল দিয়ে কিছু রুবাইয়ের অনুবাদ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি স্বরবৃত্তেই হয়তো স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁর স্বরবৃত্তে অনূদিত আর একটি রুবাই তুলে ধরছি-
রাতের দেয়াল দীর্ণ করে ভোরের আলো ফুটলো যবে,
জাগো সখি মেলো আাঁখি ঘুমিয়ে আর কী লাভ হবে?
রাজপ্রাসাদের তোরণ ছুঁয়ে উঠলো যখন প্রভাত রবি-
তারারা সব মিলিয়ে গেল, দিনের বেলা কেমনে রবে?
সত্তুরোর্ধ জনাব চৌধুরী প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে রুবাইয়ের অনুবাদের কাজটি শুরু করেন, যা তাঁর গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একটি রুবাইয়ের সূচনায় উল্লেখিত আছে। গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট ছিয়াত্তরটি রুবাইয়ের সবগুলোই, ঠিক ভাবানুবাদ বলবো না, তাঁর মুক্তহস্ত অনুবাদের ফসল। তিনি সর্বদাই রুবাইয়ের অন্ত্যমিল দেবার নিয়ম, অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ পংক্তির অন্তে একই মিল দেবার রীতিটি অনুসরণ করেছেন। তবে তাঁর রুবাইগুলো পাঠ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, খৈয়ামের ‘সুরা, সাকি ও পেয়ালা’ ভিত্তিক বেশ কিছু রুবাই তাঁর গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেননি। খৈয়ামের সূফি দর্শনের বৈশিষ্ট্য এই সুরা-সাকি প্রতীকের মাঝে নিহিত। সাকি যেন তাঁর মুর্শিদ, সুরা হলো দিব্যজ্ঞান বা পথের দিশা এবং পেয়ালা হৃদয়ের প্রতীক। আর এই দর্শনের আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে রোমান্টিক আবহ।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনূদিত রূবাইগুলো সুখপাঠ্য। তাঁর ভাষায় কোন জড়তা বা জটিলতা নেই। ক্লাসিক কবিতার অনুবাদ একটি কঠিন কাজ বটে। তাঁর এই সাধনা সফল হয়েছে বলা চলে। অনুবাদ সাহিত্যে গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো সংযোজন।
****
(অমর একুশে বইমেলা, ২০১৭ উপলক্ষে মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনূদিত রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’ প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দ্বীপজ পাবলিকেশন্স। শিল্পী টিপুলের প্রচ্ছদ ও সুন্দর কাগজে ঝকঝকে ছাপা নিয়ে চৌরাশি পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা।)
January 3 at 10:41 PM
1 hr ·
Privacy: Public




-