একদল মুক্তি নিয়ে বাবাকে দেখেছি গ্রামে,
অস্ত্র হাতে রক্তিম চোখে শরীর ভেজা ঘামে।
চোখে-মুখে আর বজ্রকন্ঠে বিদ্রোহের জ্বালা,
চাই স্বাধীন বাংলাদেশ পাক সেনারা পালা।
অন্তর পুড়ে ছাই, মুক্তি যেন চাই চাই।


বাবা গেলেন যুদ্ধে, আবার হবে কি দেখা?
আমরা কয়েকটি ভাই-বোন আর মা এ’কা।
অল্প শিক্ষিত মা আমাদের যুদ্ধের নয়টি মাস,
একদিন ফিরে আসবেন তিনি ছিল দৃঢ় বিশ্বাস।
বহু কষ্টে গেছে এক একটি দিন, যুদ্ধের নয়টি মাস।


এক রাতে ঘুম ভাঙ্গে মা’য়ের চাপা উত্তেজনায়,
বলে, বাবা ওঠ- পালাতে হবে
মিলিটারি হানা দিয়েছে পূর্ব পাড়ায়।
সেই রাতে ছুটি, ধরে মা’য়ের শীতল হাত,
এক অজানার পথে কালো-অন্ধকার রাত।


সারাটা পথ এই বুঝি এলো, এই বুঝি গুলি বিঁধল বুকে,
এই বুঝি হায়েনার দল কেড়ে নিলো সব লুটে।
এই বুঝি হারামির দল জ্বালিয়ে ঘর করে ছাই,
যুবতী নারী কি পাবে পিচাশের কাছে রেহাই?
অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে ভেবে মিলিটারি আশপাশ,
এইভাবে এক থেকে অন্য স্থানে যুদ্ধের নয়টি মাস।


ঘরপোড়া আগুনের লেলিহান,
মানুষের লাশের গন্ধে আকাশে উড়ছে উত্তাল শকুনি,
সম্ভ্রম বাঁচাতে গলায় দিয়েছে দড়ি কত কিশোরী-রমণী।
অনাহারে-অর্ধাহারে মা’য়ের অর্ধনগ্ন বেশ,
যুদ্ধের নয়টি মাস- কারো সব হয়ে গেছে শেষ।


শেষের ক’টি মাস মোদের বহু কষ্টে গেছে,
বাবার খবর যেন পাইনি কারো কাছে।
আদৌ কি বাবা আছেন? না’কি যুদ্ধ নিয়েছে কেড়ে?
না’কি ক্লান্ত দেহে বাবা গেছে শত্রুর কাছে হেরে?


যুদ্ধের নয়টি মাস- বহু কষ্টে কেটেছে মা’য়ের দিন,
আমরা ক’টি ভাই-বোন তার শুধিতে পারবোনা ঋণ।
মা’কে হাসতে দেখিনি যুদ্ধের এই নয়টি মাস,
কেবল চাপা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস।
দেখিনি মায়ের কপালে টিপ, খোঁপায় জবাফুল
দেখিনি নয়টিমাস তা’কে ফিতায় বাঁধিতে চুল।


সেদিন ছিল যেন এক মহানন্দের মেলা,
দোয়েল কোয়েল সকলে যেন মাতিল প্রভাত বেলা।
পুবের আকাশে লাল সূর্য উঠে ছিলো হেসে,
দখিনা হাওয়ায় ফুলের গন্ধে গিয়েছিল যেন ভেসে।
সেটা যেন ছিল মোদের জন্য বিশাল কোন খবর,
সেটা ছিল এক সুখের দিন যুদ্ধের নয়টি মাস পর।


দুর থেকে শুনি চিৎকার “বাবা আসছে ফিরে”
দৌড়ে যেন ছুটে চলে যাই শত মানুষের ভীরে।
গ্রামের মানুষ ভীর করেছিলো বড় রাস্তার পাশে,
দৃষ্টি সবার সড়ক পানে কখন তারা আসে।
কখন আসবে গাড়ী? কখন আসবে তারা?
কখন আসবে মুক্তি সেনারা জয় করেছে যারা?


যুদ্ধের কেটে গেছে নয়টি মাস
ভুলে গিয়ে সমস্ত দুঃখ ব্যাথা,
আধা বেলা আধা পেট খাবারের কথা।
ভুলে গিয়ে গ্রাম থেকে অন্য স্থানে,
তাকিয়ে ইট বিছানো পথের পানে।


বাবা আজ এসেছে ফিরে, দেশ করেছে জয়,
আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নেই যে কোন ভয়।
“জয় বাংলা” বলে সেদিন হিন্দু-মুসলমান
একই সুরে স’বে গেয়েছিল স্বাধীনতার গান।
বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-তাঁতি-জেলে-কামার-কুমার,
সকলে সেদিন এক ভাষতেই বলেছিল এ’দেশ আমার।
অনেক হারিয়েও যেন বুক ভরে নিই নিঃশ্বাস।
কেটে গেছে যুদ্ধের নয়টি মাস।