~ সালেহীন শিপ্রার কবিতার বই "প্রকাশ্য হওয়ার আগে " বিষয়ে যা ভাবতেছিলাম আজ দুপুরে ~


গত বছর একদিন ধানমন্ডি লেকে আড্ডা দিতেছিলাম, সন্ধ্যাবেলায়। একজন তখন বললো একটা ভালো কবিতার বই হইলো সেইটা যে কবিতার বই পড়ার পর অটোমেটিক তিন চারটা লাইন আপনার ঠোটঁস্থ হইয়া যাবে। আবার কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বইসা এক আড্ডায় শুনলাম এক কবিতার বইয়ে ৪০-৫০ টা বা তার বেশিও কবিতা থাকে, এইখান দিয়া দুই চার লাইন কেন, দুই তিনটা কবিতা ভাল হইলেও কিছুই না, আল্টিমেটলি, বইটা ভালোনা। আবার ধরেন, ভাল কবিতা, খারাপ কবিতা বলতে কিছুই নাই, টাইপের কিছু কথা ও শোনা যায়। আমি আসলে শুনি। মানুষ এত্ত বলে, বলতে জানে। আসলে, কবিতায় চিত্রকল্প, ছন্দ, মিথ, আরো নানান প্রকার টুলস ইউজ করা হয়, বা অন্য ভাবে বলতে গেলে, কবিতা তো কবির কাছে নাজিল হয়, তো নাজিল হবার সময়ই এই টুলসগুলা সহই নাজিল হয়। যেকারনে গল্প, উপন্যাস এর তুলনায় কবিতা পাঠকের বেশিই মনযোগ দাবী করে, যোগ্য দাবীদারের মতন।


"প্রকাশ্য হওয়ার আগে " কবিতার বইখানা সালেহীন শিপ্রার প্রথম কবিতার বই। "প্রকাশ্য হওয়ার আগে " এমন এক কবিতার বই যার পুরোটাতে একটাই সুর, গভীর বিষাদের সুর।


" ছায়ার উপর থেকে ছায়া সরে গেলে
দৃশ্যত হেরফের নাই "


"কেননা, তোমার চুলে মাঝে মাঝে অন্য অন্ধকারের গন্ধ লেগে থাকে "


"এখন ফিরে যাচ্ছে প্রেম
বুড়ো বৃক্ষ শোন, পাতা ঝরছে খুব বাতাসের ডানায় "


এসকল লেখাই একজন কবির, সালেহীন শিপ্রার। আমাদের সময়ে কবিতায় যখন প্রচুর হট্টগোল, ঠিক তখনই মায়া মায়া শব্দের বুননে একজন সালেহীন শিপ্রা লিখে চলছে জীবনকে। নিবিড় সাবলীলতায় ছুয়ে দিচ্ছে জীবনের নির্জন সে পথ, নিদ্রিত তাঁবুর পাশে জেগে থাকা রহস্য। কবিতা লেখার দীর্ঘ সময় পরে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উনি যেন সেই দীর্ঘসময়ের প্রতিমুহুর্ত, প্রাচীন ক্ষতের ছাই উড়াতে চেয়েছেন " প্রকাশ্য হওয়ার আগে " কাব্যগ্রন্থে। আর কবি খুব সফলভাবে পেরেছেন ও উড়াতে, ৩৫ টি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস।


ভাস্কর চক্রবর্তীর ১৯৮৩ এর ডায়েরীতে পড়েছিলাম " সাহিত্যের গোলমাল থেকে দূরে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে কবিতার যে এক দারুন নির্জনতা আছে, সেই নির্জনতায় ঢুকে পড়ছি ক্রমশ "। সালেহীন শিপ্রা কবিতা লিখছেন এই শান্ততম, প্রচন্ড নির্জন দুনিয়া থেকে। লিখছেন -
" ভেজা শাড়ি গোটাতে গোটাতে দশটি আঙুল ভিজে যাচ্ছে "


দীর্ঘশ্বাসের প্রবাহিত ব্যাকুল হাওয়ায় চিৎকার যে কবি নিজেই ভাসিয়ে দিয়েছেন তা পাঠকের কাছে দৃশ্যমান আবার অদৃশ্য এক সুর। যে সুর মেলে ধরেছে শান্ত বিষাদের ঝুড়ি আর নিভৃত দর্শন। দুর্দান্ত সততা ও নিবিড়তা আছে বলেই
" লাল আলো পথ আটকাবার
সক্ষমতা নিয়েও আছ।
চলে যাবার পথ এতটা সহজ হতে পারে! "
লাইনগুলির পাখির মতন ডানা গজায়, উড়ে গিয়ে বসে থাকে চুপ, কবিতাপাঠকের পাঁজরের কাছে।


"তোমার গানের পাশে অপভূবিন্দু ছেড়ে নেমে আসে চাঁদ। হিমকনা ঝরে পড়ে অতলান্ত বিষাদের ক্ষতে " ঠিক এভাবেই নয়ত " উড়িয়ে দেওয়া ব্রিজের পাশেই ধানক্ষেত
এবড়ো থেবড়ো নদীপাড়
জলের গভীর থেকে,
না ফেরা ছেলের মুখ
মায়া -হাহাকার " এভাবেই সালেহীন শিপ্রার কবিতার পঙতি উন্মোচন করে সেই মগ্নপৃথিবীর বিভা। আর পাঠকের হৃদয়ে " প্রকাশ্য হওয়ার আগে " কাব্যগ্রন্থের ২৫ শে জুন কবিতা হতে বেরিয়ে আসা জোনাকিরাত্রির ট্রেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের প্লাটফর্মে। সে ট্রেনের ও থাকে বুঝি ভীষন বৃষ্টিপিপাসা। যে পিপাসা নিয়ে সালেহীন শিপ্রা লিখে যায় উৎসর্গপত্র মুছে যাওয়ার আগের রোদ্দুরকে।


মলয় দত্ত
১৭/৩/১৮।