ছোটবেলায় হালখাতার কথা শুনতেই জিভে পানি আসত।
বৈশাখ মাসে ডাক্তারবাবুর হালখাতার চিঠির জন্য
উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
সেবার হলো কী
কোনো দায়-দেনা ছিল না।
আমিও সবকিছুই বুঝতাম না।
হালখাতার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল।
গরিবের ঘরে জন্ম আমার-


হালখাতার প্যাকেটের উপর বরাবরই লোভ ছিল।
কী প্রতীক্ষা ছিল আমার!
চাতক পাখির ন্যায় আমার দিনগুলো কাটতে লাগল।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলো।
কিন্তু হালখাতার চিঠি হাতে না-পাওয়ায় মনটা ভীষণ খারাপ ছিল।
আবেগে আপ্লুত ছিল মন


কিন্তু কী করার!
রাস্তায় দেখলাম অনেক মানুষ হালখাতার প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরছে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম
শেষপর্যন্ত পৌঁছালাম ডাক্তারবাবুর চেম্বারে।
সেই সময় কেউ সেখানে ছিল না।
আমার চোখটা ছলছল করছিল।
ডাক্তারবাবু কিছু বলার আগেই-


আমি তো বলেই ফেললাম হালখাতা নিতে এসেছি।
ডাক্তারবাবু আমাকে দেখে বিব্রত সুরে
বলেই বসলেন : তোদের তো চিঠি দিইনি এবার।
কিছুক্ষণ পর খানিকটা স্নেহের পরশে আগলে নিয়ে
হাতে এক প্যাকেট খাবার দিয়ে বললেন-


বেশ হয়েছে তুই এসেছিস!
আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে
বাড়ির দিকে দৌড়ে রওনা দিলাম।
খানিকটা মনে হলো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।


বাড়ি পৌঁছাতেই মা জিজ্ঞাসা করলেন
তোর হাতে ওটা কী?
আমি বললাম : ডাক্তারবাবু দিয়েছে-
ওটা হালখাতার প্যাকেট।
মা, সাথে সাথে বলে উঠলেন-
কৈ, চিঠি তো আমরা পাইনি।
মা, আমাকে বকুনি দিয়ে প্রহার করলেন।
বললেন
তোর খাওয়ার এত লোভ!
মনটা কষ্টে ভরে গেল-


হঠাৎ যেন হৃদয়-আকাশে একপশলা বৃষ্টি।
আবেগে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।
কেঁদেছি অঝোর ধারায়।
মায়ের অনুশাসন থাকলেও
আমি সেদিন নিজের লোভ সম্বরণ করতে পারিনি।
আমি তো ওই সমাজেরই একজন ছিলাম-


যাদের জীবন কাটত দুবেলা দুমুঠো খাবারের অšে¦ষণে।
পরে মা আমাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে-
বুকফাটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন


বাবা পরের কাছ থেকে চেয়ে কিছু নিতে নেই।
খানিক পরে মা হাতের মুঠোয় থাকা
প্যাকেটটা খুলে আমাকে খাইয়ে দিলেন।
আহ্! কী স্বাদ ছিল সেই খাবারের!
খুব তৃপ্তি ভরে খেয়েছিলাম সেদিন।
আজও বছর ঘনিয়ে হালখাতার দিন আসলে


মনে পড়ে সেইদিনের কথা।
আর মনে পড়ে নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত
সমাজের ওই সমস্ত শিশুদের হাহাকারের কথা।
যারা হালখাতার প্যাকেটের মতো এক প্যাকেট
খাবারের আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে সারাদিন।
আমি হালখাতার খাবারের প্যাকেট সেদিন পেয়েছিলাম।
ওরা, আজ আমার মতো খাবারের প্যাকেট পায় কি?