অগনিত প্রহর পরে
এসেছিনু সেবার ফিরে ,
নিঙরায়ে দিতে তোমারে
বুকের জমানো ভালবাসা ।
আসিয়া ফিরে শুনি তুমি ঘরে ,
ভাবিলাম তবে হয়তো অভিমানে
মুখখানি রাখিছ বালিশে লুকায়ে ।
হেনকালে যবে প্রবেশিনু ঘরে
দেখিনু তোমারে বিছানার 'পরে ।
মলিন মুখে পলকহীন চোখে ,
যেন বিস্ময়ে দেখিছ মোরে ।
কহিনু "কি দেখিছ অমন করে ,
ওগো মোর মনহারিণী ?
ওঠো এবার , ছাড় মান ,
খোল অধরের তালাখানি ।
বল শুনি মধুর বাণী ,
জুড়াই এ প্রাণ প্রিয় স্বরে ।
কি হল এবে, কথা কওনা কেনে ?
ছাড় মান দিওনা কষ্ট প্রাণের সখারে ।
দেখ চাহি , এনেছি তোমার লাগি
বানারসি শাড়ি , কাঁচের চুড়ি ,
সিথীর সিঁদুর , লাল টিপ ,
আরও কত কি , এই দেখ চাহি !
কি গো লো, কথা কওনা কেনে ?"
এবার হৃদয়খানি উঠিল কাপি ,
তাহারে কি ধরিছে বিমাড় ?
তবে কেনে প্রিয়া কথা কয় না আর ?
ব্যাকুল হৃদয়ে যবে ছুইনু তোমারে ,
দেখি হিমশীতল দেহখানি ।
বুঝিনু তখনই , মোর পরাণ পাখি
গিয়াছে উড়ি , তাইতো শূণ্য খাঁচাখানি ।
যারে মুই ডাকি , সে তো আজি নাহি ,
কে কহিবে কথা ? এত আয়োজন কার লাগি ?
বুকে জড়ায়ে ধরি শতবার ডেকেছি ,
মোর আর্তনাদে বোধহয় কেঁদেছিল পৃথিবী ।
যমের হাত থাকি নিতে চাহিনু কাড়ি ,
পারি নাই , আগেই গিয়াছে চলি।
অবশেষে , লাল শাড়ি জড়ায়ে সিঁদুর পরায়ে ,
আপনার অর্ধখানি আপনার হাতে ,
শেগুন কাঠের রাঙা চিতায় শোয়ায়ে ,
নিঠুর শ্মশানে আপনার সোহাগেরে
পোড়ায়েছিনু সেদিন , ক্ষুধিত আগুনে ।
সে যে কেমন জ্বালা , বুঝিতে সখী,
এমন অভাগা হয়ে আসিতে যদি ।
এই শ্মশানে পোড়ায়েছি আপন হাতে
আপনার পিতা বিশ্বনাথেরে ।
ঐশ্বর্যের মাঝে বেড়ে ওঠা পিতা মোর ,
অভাবের কষাঘাতে , পারি দিল পরপারে ।
সিঁদুরহীনা মা মোর স্বামী শোকে
সাতদিনও রহিল না , সাড়া দিল তাঁর ডাকে ।
তারেও পোড়ায়েছি এই শ্মশানে ,
সে যে কত কষ্ট , তা কি পাথর সহিতে পারে ?
চাঁদের মতন ফুটফুটে মোর ছোট ভাইটি
রুপে গুণে যেন স্বয়ং রাম জী ।
চাঁদের মতন মুখে তাহার থাকিত সদা হাসি
জ্ঞানের আশে শত কৌতুহলে ছিল সে কৌতুহলী ।
ভেবেছিনু , ভাই মোর বড় হয়ে ,
ফুল ছিটাবে কুলের মুখে ।
আশার মুখে ছাই দিতে সহসা সেদিন তারে ,
ধরিল অচীন বিমাড়ে ।
শত চেষ্টা , ডাক্তার কবিরাজে সাড়িল না ,
সাড়া দিল শ্মশানের ডাকে ।
মুই অভাগা আপনার হাতে
পুড়িনু তারেও শেগুনের খাটে ।
আহা কহিতে যে আজ পরাণ ফাঁটে ,
ভীষণ আর্তনাদে কাঁদিয়া ওঠে মন ।
আপন বলিতে একে একে
সবারেই পুড়িনু , এই শ্মশানের ঘাটে ।
শুধু বাকি থাকিল দিদি ,
কৃপন স্বামীর সাথে হয়েছিল সাদী ।
একদা হঠাত্‍ পদব্রজে , আসিয়া হাজির উঠোনে ,
হাসিমুখে নয় কিছুটা অবাক হযে
জিজ্ঞাসীনু "কেনে গো দিদি পায়ে হেঁটে ,
গতরে এত আঁচর লাগিল কেমনে ?"
কোন উত্তর পাইনু না ,
সোজা চলিল ঘরে ।
বুঝিনু যৌতুকের লাগি ,
জোড় করে পাঠায়েছে স্বামী ।
কথা না বাড়ায়ে চলিনু টাকার খোঁজে ,
না পেয়ে বেচিনু জমিটুকু বাবুদের কাছে ।
টাকা নিয়ে আসিয়া বাড়ি ,
কহিনু "ওঠ গো দিদি , টাকা আনিছি ,
কর না দেরি , তরা করি যাও বাড়ি ,
সুখে সংসার গড় নিয়ে সন্তান স্বামী ।
হিদুর ঘরে জন্মেছি এটাই বড় শাপ ,
যৌতুক দিতেই হবে নইলে পাব না মাপ ।"
এতেক কহিয়া যবে প্রবেশিনু ঘরে,
দেখি দিদি নাই ,মলিন দেহ রেখে
চলিয়াছে পরপারে ।
অভাগা মুই , দু:খ ক্ষোভ মনে রেখে ,
তারেও পুড়িনু এই শ্মশানে ।
এতটুকু বয়সে , বংশের প্রদীপগুলোরে
একে একে নিভাইনু হেথায় , এই শ্মশানে ।
একা হয়ে একদা চাঁদনী রাতে ,
তোমারে মুই তুলিনু ঘরে ।
ভেবেছিনু আবার মোর ভরিবে সংসার ,
কিন্তু ভাগ্য দোষে রহিনু সন্তানহীন জনমে ।
অভাবের তাড়নে একদা গেনু শহরে ,
কিছু টাকা কামাইয়া ফিরিমু ঘরে ।
কিন্তু শহর , সে তো বড় কঠিন ,
কাম না পাইয়া গেল বহুদিন ।
অবশেষে বহু কষ্ট ,
কিছুটা কামাইয়ে ,
ফিরিনু ঘরে ।
ফিরে দেখি তুমি নাই ,
মোরে ফেলে চলিছ ওপারে ।
সেই থেকে মুই শ্মশান বাসী ,
শ্মশান মোর ঠিকানা ।
হেথা মুই মোর স্বজনেরে পাই ,
পাই তোমার ছোয়া ,
তোমারে ফেলিয়া তাই যাইমু বল কোথা ?