অনেক লিখেছি মানুষের সুখ, দুঃখ ঘিরে
এবার ফিরে আসি নিজের জীবনের দিকে।
কোন এক জোছনা ভরা রাতে
জন্মেছিলাম আমি বড়মুড়ার মাষ্টার বাড়িতে।
পৃথিবীর গরম হাওয়া লেগেছিলো গায়ে
কেঁদেছিলাম আমি ভীত হয়ে
বুঝতে পেরেছিলো কোমলমতি জননী
জড়িয়ে লয়ে ছিলো বুকে।


আমার বড় ছিলো এক ভাই, এক বোন
এবং ছোটও ছিলো এক ভাই, এক বোন
বাবা ছিলো হাই স্কুলের শিক্ষক আর মা ছিলো গৃহিণী
গোয়াল ভরা গরু আর গোলাভরা ধান
বেশ সুখেই কাটছিলো আমাদের দিনকাল।
বাড়ির চারপাশ ছিলো জনমানবহীন, লোকালয় হীন
বাঁশ বাগান আর আম কাঁঠাল গাছে ঘেরা,
সন্ধ্যা হলেই খেঁকশিয়ালে কেটে ফেলতো গোয়াল ঘরের বেড়া।
সব ভাইবোন মিলে, জানলার কপাট দিতাম খোলে
বাঁশ বাগান ছেড়ে জোনাকপোকা আসতো মোদের ঘরে
মুঠোমুঠো জোনাকপোকা আটকিয়ে দিতোম মশারীতে
সারারাত মিটিমিটি জ্বলে, আলো দিতো ছড়িয়ে।


এই হাসিখুশির মাঝে পড়লো ভেঙে আকাশ
চলে গেলো মা, হারিয়ে গেলো মা এই ঘরকে করে আঁধার
ঘরের মাঝ খানের মাটিতে পরেছিলো মায়ের নিথর দেহ
চারপাশে আগরবাতি মিটিমিটি জ্বলছিলো।
বরই পাতার গরম জলে গোসল করাইয়া
নিয়ে গেলো মা'কে খাটিয়ায় শুয়াইয়া।
কাঁদিতে কাঁদিতে, চোখের জল মুছিতে মুছিতে
গিয়েছিলোম মায়ের পিছুপিছু
কবরে রেখে সবে মিলে মাটিচাপা দিয়েছিলো।


মা চলে গেলো নেমে এলো দুর্ভিক্ষ
কি কারনে নেমে এলো তা বলা না-ই হলো।
এইভাবে কেটে গেলো অনেক বছর
ভাইয়া পড়ে উপজেলার বড় এক মাদ্রাসায়
আপু হাইস্কুলে, আমি প্রাইমারি বাকি দুইজন যায় আসে।
আমি ছিলাম বাউন্ডেলে
আম কাঁঠালের দিনে প্রতিটি গাছে আমার হাতের ছোঁয়া না লাগলে তাদের ঘুম আসতো না
হাতে দা নিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশ ঘুরে বেড়াতাম।


ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবার ভাইয়া বাড়ি ফিরবে
হাটে যাচ্ছিলাম কিছু আনবো বলে
পথিমধ্যে ভাইয়ার সাথে দেখা, কৌশল বিনিময়
ভাইয়া চলে গেলো বাড়ি আর আমি হাটে।
গোধূলি নগ্নে হাট থেকে ফিরে দাড়িয়ে ছিলোম উঠুনে
সূর্যের আলোটা গাঢ়, রক্তিম, আঁধার নেমে আসবে
বাঁশ বাগানে পাখির কোলাহল, হুতুম পেঁচার গোংরানি।
বাবা স্কুল থেকে ফিরে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিলো ভাইয়ার
এতো মাস পরে বাড়ি এলো, একটু দেখবে, দু চারটি কথা বলবে
সমস্ত গ্রাম ঘুরে ভাইয়া বাড়ি ফিরে এসে
হাতে দা নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দক্ষিণ দিকে
বাবা ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো "কেমন আছ বাবা"?
ভাইয়া বলেছিলো "খুব ভালো"
বাবা বসতে বললো,
ভাইয়া বললো "একটু কাজ সেরে আসি"।


অন্ধকার হয়ে এলো,
জেলেরা মোদের বাড়ির উত্তর পাশের জঙ্গলে
গোংরানির আওয়াজ শুনতে পেলো
চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলো
দৌড়ে এলো পাড়াপ্রতিবেশি।
দেখতে পেলো আঠারো বছরের টগবগে যুবক
পা কাটা, রক্তে লাল সাদা জামাটা, দু একটি বোতামও ছিড়া, লালা ঝরছে মুখ দিয়ে
দৌড়ে গিয়ে দেখি এ আমার ভাইয়া।
কে যেনো পাঁজা কোলা করে
উঠুনে এনে শুয়াইয়ে দিলো তাকে
মুখের দিকে তাকি আছি এক দৃষ্টিতে
ইশারায় ডাকছে, কথা বলার চেষ্টা করছে
কোন শব্দ বের হচ্ছে না।
দেখার মাঝেই নিস্তেজ হয়ে এলো হাত
বন্ধ হয়ে এলো চোখ, নিথর হয়ে গেলো দেহ।
আমি চিৎকার করে কাদিতে চাহিয়া
করিতে পারিনি চিৎকার।
"পৃথিবীর ভারী বুঝা পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ"
বাবা গোংরাচ্ছিলো, ডানা ভাঙা পাখির মতো ধাপড়াচ্ছিলো আর ধাপড়াচ্ছিলো।


যে হাতে মা'কে, ভাইকে মাটি চাপা দিলাম
আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেই হাতেই কলম নিলাম।
তারপর কেটে গেলো অনেক বছর
শক্ত হয়ে গিয়েছিলো মন।


কোন একদিনের কাক ডাকা স্নিগ্ধ ভোরে
ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো মোর মামাতো বোনের সাথে আসা
আখাউড়া হীরাপুরের নাজমিনের হাসির শব্দে।
এক পলক চেয়ে দেখেছিলুম তারে
হরিণীর চোখ, বেদানার মতো গাল
নিমিষেই হারিয়ে গিয়েছিলুম তার মাঝে।
আখাউড়া রেলস্টেশন, উপজেলা মাঠ একসাথে ঘুরে
কাটিয়ে ছিলাম দিনকাল আনন্দের মোহের ঘোরে
বাসনা নামক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিলো হৃদয়ে
পেতে চেয়েছিলো তাকে খুব কাছে।
কোন এক বসন্তের রাতে
সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে
পেয়ে গিয়েছিলোম তাকে একই বালিশের সঙ্গী হিসেবে।


দুই বছরের সংসার জীবনে
অনেক রাগ অভিমান ছিলো মিশে।
নাজমিনের অভিমান, অভিযোগ গুলো গাঢ় হচ্ছিলো
তারমধ্য মোদের কোল জুড়ে এক মেয়ে এলো
ভেবেছিলাম আমি আমার মতো করে
অভিযোগ, অভিমান গুলো ভুলে যাবে নাজমিন মেয়ের দিকে চেয়ে।
ত্রিশ দিন পর তার বাপের বাড়ি থেকে লোকজন এলে
চলে যায় বাপের বাড়ি মেয়েকে সাথে নিয়ে।
যাবার বেলায় বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি
"আমি যাচ্ছি চলে দূরে বহুদূরে
আমার তালাশে হয়ো নাক তুমি ভবঘুরে "।


চলে যাওয়ার এক মাস পরে
কোন কার্তিকের ভর দুপুরে
নাজমিনের পাঠানো চিটি ডাকপিয়ন নিয়ে এলো ঘরে
নাজমিনের অভিযোগ গুলো লিখা ছিলো স্পষ্টাক্ষরে।
আমি মাতাল বড্ড মাতাল, খোঁজ রাখি না তার
মধ্য রাতে ঘরে ফিরে করি উতালপাতাল
যৌতুকের লাগি মারধর করি, ক্ষতি সাধন করি মস্তিষ্কের।


এই অভিযোগ এনে ছেড়ে গিয়েছিলো আমায়
ফিরিয়ে দিয়েছিলো মেয়েকে।
তার চলে যাওয়া সইতে পার ছিলো না হৃদয়
নষ্ট হয়ে গিয়েছিলোম ভবে
জীনের উপর, দেহের উপর অমানবিক নির্যাতন করে
ক্ষান্ত হয়ে গিয়েছি অবশেষে।
মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখে ছিলোম
বেঁচে রয়েছি তাঁর মুখপানে চেয়ে।