বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে আবার নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতরাত ১৬ জুলাই ২০২৫। প্রয়াত হয়েছেন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক ও শিক্ষাবিদ মহিবুর রহিম। ইন্না-লিল্লাহ...। তিনি ছিলেন কেবল একজন লেখক নন, তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং লোকজ সংস্কৃতির এক নিবেদিত প্রাণ সাধক। তাঁর অকালপ্রয়াণে জাতি হারাল এক নিঃস্বার্থ সাধক, সাহিত্য হারাল এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, গবেষণা জগৎ হারাল এক নিষ্ঠাবান অনুসন্ধানী মন।
মহিবুর রহিমের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামে—বাংলার ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত এক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ভূভাগে। শৈশবেই তাঁর সাহিত্যপ্রেম ও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে যায় গভীর সাহিত্য সাধনার পথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি সক্রিয়ভাবে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে প্রস্তুত করেন এক নিবেদিত লেখক হিসেবে।
তাঁর সাহিত্যকর্মে যেমন আধুনিক জীবনের দুঃখবোধ, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় গ্রামীণ লোকজ জীবন ও প্রকৃতির গভীর মায়া। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলো হলো—
‘অতিরিক্ত চোখ’,
‘হে অন্ধ তামস’,
‘অনাবাদি কবিতা’,
‘দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র’,
‘সবুজ শ্যামল মন’,
‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’,
‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’।
এই কাব্যগ্রন্থগুলো শুধু কাব্যরস নয়, পাঠককে ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। এছাড়াও তাঁর ‘হাওর বাংলা’ এবং ‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোকসাহিত্য’ গ্রন্থ দুটি লোকজ সংস্কৃতি ও ভাষার ক্ষেত্রেও অমূল্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত।
তাঁর গবেষণাধর্মী কর্মক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক সমীক্ষা গ্রন্থমালা’-য় তাঁর লেখাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লা অঞ্চলের লোকসংগীত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসাহিত্য এবং ভাটি বাংলার মৌখিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা একাডেমির ‘লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ কর্মসূচি’-র আওতায় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসাহিত্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন।
লোকসাহিত্য গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘প্রজ্ঞা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পদক’ এবং ‘স্মৃতি ৫২ সম্মাননা’ লাভ করেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য পেয়েছেন—
* ‘রকি সাহিত্য পদক ২০১১’
* ‘মেঠোপথ সাহিত্য পদক ২০১৩’
* ‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহিত্য পদক ২০১৪’
* ‘সুকুমার রায় সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা ২০১৮’।
একজন অনন্য গবেষক ও কবি হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক সফল শিক্ষকও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইর BSM কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন ছাত্রদের মাঝে সাহিত্যপ্রেম ও মননশীলতা জাগিয়ে তুলেছেন।
তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্য ও গবেষণা জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের মাঝে তাঁর কণ্ঠস্বর হয়তো আর শ্রুতিযোগ্য নয়, কিন্তু তাঁর লেখায়, তাঁর গবেষণায়, তাঁর ছাত্রদের স্মৃতিতে ও পাঠকের হৃদয়ে তিনি চিরঞ্জীব।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি কবি মহিবুর রহিমকে।
তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।