আর নয় দ্বিধা ভয় দ্বন্দ্ব
শিখে ফেলুন কবিতার ছন্দ।
ছন্দ শেখার দ্বন্দ্ব যাদের মনে
এই লেখাটা পড়বেন
শুধু সেই জনে।
মন্দ কথার গন্ধ না ছড়ায়ে
ছন্দে পটু পণ্ডিতজনে
সযতনে যাবেন এড়ায়ে।


আমরা এতক্ষণে শব্দের অক্ষর বের করা শিখে নিয়েছি। এখন শিখব বিভিন্ন প্রকার ছন্দে অক্ষর অনুসারে মাত্রার ব্যবহার এবং পর্ব বিষয়ে আরো কিছু তথ্য। প্রথমেই শিখব স্বরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে। এর আগে আমরা পর্ব সম্পর্কে জেনেছি। এখানে পর্ব সম্পর্কে আরেকটু বিষয় জানব। যে বৃত্তের ছন্দে যত মাত্রা নিয়ে মূল পর্ব গঠিত হয় তাকে বলা হয় পূর্ণ পর্ব। পূর্ণ পর্ব অপেক্ষা কম মাত্রা নিয়ে কোনো পর্ব পূর্ণ পর্বের পূর্বে বসলে তাকে বলা হয় অতিপর্ব এবং পরে বসলে বলা হয় অপূর্ণ পর্ব। আবার পূর্ণ পর্বেও ছোট ছোট অংশ থাকতে পারে, তাকে বলা হয় উপ-পর্ব।


এখানে আমরা আরেকটি বিষয় জানব। সেটা হলো মধ্যখণ্ডন। মধ্যখণ্ডন হচ্ছে কোনো অপূর্ণ পর্বকে পূর্ণ পর্ব বানাতে পরের শব্দকে অক্ষরে ভেঙে একটি অক্ষর (বর্ণ নয়) তার সাথে যুক্ত করা। ছন্দবিষয়ক আলোচনায় যখন উদাহরণ দিবো তখন বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।


স্বরবৃত্ত ছন্দ:


স্বরবৃত্ত ছন্দকে ছড়ার ছন্দ বলা হলেও আধুনিককালে গুরুগম্ভীর কবিতাও স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য হলো:


ক) সাধারণত এটি দ্রুত লয়ের ছন্দ। টাট্টু ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে চলা এর মূল বৈশিষ্ট্য।
খ) পুরো কবিতায় সকল চরণে মূল পর্বটি ৪ মাত্রার হয়।
গ) মূল পর্বের পূর্বে ৪ মাত্রার কম (১-৩ মাত্রার) অতিপর্ব এবং পরে অপূর্ণ (১-৩ মাত্রার) পর্ব ধারণের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
ঘ) ভোগ করতে পারে শব্দের মধ্যে মধ্যখণ্ডনের সুবিধা।
ঙ) মূল পর্বে সাধারণত ৪ মাত্রা থাকা আবশ্যক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ মাত্রার শব্দ বাক্যাংশ ৪ মাত্রার এবং ৫ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশ ৪ মাত্রার মূল্য লাভের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
চ) মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা গোনতে হয়।
ছ) থুতনি পদ্ধতিতে অক্ষর ও মাত্রা বের করা যায়।
জ) প্রতি চরণে পূর্ণ পর্বে মাত্রার সংখ্যা সমান অর্থাৎ ৪ মাত্রার হওয়া আবশ্যক হলেও অতিপর্ব বা অপূর্ণ পর্বে মাত্রার সংখ্যা সমান হওয়া আবশ্যক নয়।
ঝ) পঙক্তি বিন্যাসে প্রত্যেক পঙক্তির মোট মাত্রা সমান হওয়াও আবশ্যক নয়।


উদাহরণ: এই ছন্দটি ছড়া এবং গানে বেশি ব্যবহার হয় বলে প্রথমে একটি গানের কলির উদাহরণ দিলাম।


দরবারে তার ছিলো আমার সোনার সিংহাসন
আমি হাজার হাতের সেলাম পেলাম পেলাম না তো মন
আজ মখমলের ঐ পর্দাগুলো
ওড়ায় শুধু স্মৃতির ধুলো
ফুলবাগানের বাতাস এসে আছড়ে পড়ে যেই
দেখি মুকুটটা তো পড়ে আছে রাজাই শুধু নেই
(কথা:পুলক বন্দোপাধ্যায়, সুর: নচিকেতা ঘোষ)


গানের এই কলিটির শব্দগুলো থেকে পূর্বে উল্লেখিত নিয়মে অক্ষরগুলো বের করে নিয়ে পর্ব বিভাজন করি।


দর+বা+রে+তার (৪ মাত্রা)/ছি+লো+আ+মার (৪)/সো+নার+সিং+হা (৪)/সন(১)
আ+মি (২)/হা+জার+হা+তের (৪)/সে+লাম+পে+লাম (৪)/পে+লাম+না+তো (৪)/মন(১)
আজ(১)/মখ+ম+লের+ ঐ(৪)/পর+দা+গু+লো(৪)
ও+ড়ায়+শু+ধু(৪)/স্মৃ+তির+ধু+লো(৪)
ফুল+বা+গা+নের(৪)/বা+তাস+এ+সে(৪)/আছ+ড়ে+প+ড়ে(৪)/যেই(১)
দে+খি(২)/মু+কুট+টা+তো(৪)/প+ড়ে+আ+ছে(৪)/রা+জাই+শু+ধু(৪)/নেই(১)


আগেই বলেছি যে, বাক্য বা চরণের যতটুকু একসাথে পড়ে সামান্য থামতে হয় ততটুকু অংশকে পর্ব বলা হয়। উক্ত উদাহরণটির ১ম চরণে-(দরবারে তার) এটুকু পড়ে যতি দিতে হচ্ছে। এ কারণে এটি একটি পর্ব। আবার (ছিলো আমার) এটুকু পড়ে যতি দিতে হচ্ছে বলে এটিও একটি পর্ব। এভাবে (সোনার সিংহাসন) এক সাথে পড়া গেলেও প্রতি পূর্ণ পর্বে যেহেতু ৪ মাত্রা থাকতে হবে সেহেতু (সিংহাসন) শব্দটি হতে (সিং+হা) অক্ষর দুটি নিয়ে (সোনার সিংহা) পর্যন্ত ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব রেখে (সন) অক্ষরটি আলাদা করা হয়েছে। এরূপ শব্দ ভেঙে অক্ষর আলাদা করার নামই হচ্ছে মধ্যখণ্ডন।


২য় চরণে-(আমি) বলার পর একটু থামতে হচ্ছে। একারণে আমি একটি পর্ব। যেহেতু এই পর্বটির মাত্রা মূল পর্ব থেকে কম এবং মূল পর্বের পূর্বে অবস্থান নিয়েছে এ কারণে এটিকে বলা হয় অতিপর্ব। এভাবে ৩য় চরণে (আজ), ৬ষ্ঠ চরণে (দেখি) পড়ে সামান্য থামতে হচ্ছে এবং পূর্ণ পর্ব অপেক্ষা কম মাত্রা নিয়ে পূর্বে অবস্থান করছে বলে এগুলো অতিপর্ব।


১ম, ২য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ চরণের শেষে (সন), (মন), (যেই), (নেই) যেহেতু পূর্ণ পর্বের শেষে অবস্থান এবং পূর্ণ পর্ব থেকে মাত্রা সংখ্যা কম সেহেতু এগুলোকে বলা হয় অপূর্ণ পর্ব।


এরূপ আমার একটি গীতি কবিতার উদাহরণ:


যদি/ ভেঙে যায় ঘর/ কালবৈশাখী/ ঝড়ে
যদি/ ঊড়ে যায় প্রেম/ বাতাসের তো/ড়ে
বলো) রুখি তা কী/ করে
বলো) রুখি তা কী/ করে?


চাঁদেরো আ/কর্ষণে আ/সে যে জোয়ার
বালির বাঁধে/ কি তা মানে
ভেসে যায় য/দি বর্ষার ন/দী ভাটার টা/নে
বলো) রুখি তা কী/ করে
বলো) রুখি তা কী/ করে?


যদি/ যেতে চাও-যাও/ ডাকব না পি/ছু আর
মন চায় যদি/ নিরবধি/ ভেঙে যাও অঙ/গী কার।


ভেঙে যায় যাক/ স্বপনের ঘর,/ ভেবো না তু/মি
হৃদয়ভূমি/ পেতে দেবো/ পথ পরে
কণ্টক পথে/ হেঁটে যেতে/ যেতে
যেন) রক্ত না ঝ/রে
যেন) রক্ত না ঝ/রে।
(যদি ভেঙে যায় ঘর)


আমার লেখা আরও একটি গীতি কবিতা:


চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে) সকাল সাঁঝে
অন্ধকারের/ আঁচল টেনে/ পুলক প্রাণে/ সঙ্গোপনে
শরীর ঢাকি/ লাজে।


রঙের ফাগুন/ পার হয়ে যায়,/ করুণ সুরে/ পিক গেয়ে যায়
তবু মেয়ের/ দক্ষিণ দুয়ার/ আজো খুললো/ না যে!
চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে) সকাল সাঁঝে।


শীতের শেষে/ জীর্ণ পাতা/ উত্তরী বায় ঝ/রে
ঘুম ভেঙে যায়/ ব্যাকুলতায়/ তারই পায়ের
আওয়াজ মনে/ করে।


আসলো না সে,/ হাসলো না সে,/ ভাসলো না সে/ প্রেম যমুনায়
তার হাসিমুখ/ দেখে পাই সুখ/ ফুলের হাসির/ মাঝে।
চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে/ সকাল সাঁঝে।
(চারু বুকে চুড়ির আওয়াজ)


আমার লেখা একটি কবিতার উদাহরণ:
ঘুমের মাঝে চোখে ভাসে
শেখ মুজিবের ছবি
জগত আলো করতে যে আর
ওঠবে নাকো তারচে বড় রবি।


কর্ণে শোনি সাতই মার্চের
বজ্রকণ্ঠ ভাষণ
রাজা হননি যখন তিনি
রাজার মতো দেশ করেছেন শাসন।


তাঁর ভয়েতে ভীত হয়ে
পাকি জানোয়ার
ধরে এসে অবশেষে
কণ্ঠ চেপে তাঁর।


বন্দী করে নিয়ে গেলো
অন্ধ কারাগারে
এমন কারা আছে কোথায়
রাখতে তাঁরে পারে!


আসেন ফিরে হাসিমুখে
ফাঁসির মঞ্চ থেকে
নিঃস্ব যখন পাক বাহিনী
বিশ্ব তখন অবাক চোখে দেখে।


বিশ্ব জুড়ে এমন নেতা
ক’জন বলো আছে
হার মানেননি প্রাণের ভয়ে
দুঃশাসনের কাছে?


মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে
উচ্চ শিরে ফিরেন বীরের বেশে
বুকে ক্ষত রক্তস্নাত
স্বপ্নের) স্বাধীন বাংলাদেশে।


সারা জীবন গেয়ে তিনি
জয়ো বাংলার গান
দেশের জন্য দেন বিলিয়ে
স্বজনসহ প্রাণ।


এমন নেতার হয় না মরণ
থাকেন চিরঞ্জীব
মরেও তিনি আছেন অমর
প্রাণের শেখ মুজিব।
(শেখ মুজিব চিরঞ্জীব)


এবার স্বরবৃত্ত ছন্দের যেসকল বৈশিষ্ট্যের কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি তার সাথে মিলিয়ে নিন। দেখবেন ঙ) ছাড়া সকল বৈশিষ্ট্যই পেয়ে গেছেন।


স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-১


স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য ঙ) তে বলা হয়েছে মূল পর্বে সাধারণত ৪ মাত্রা থাকা আবশ্যক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশ ৪ মাত্রার এবং ৫ মাত্রার শব্দ বাক্যাংশ ৪ মাত্রার মূল্য লাভের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।


সেটা কিভাবে ঘটে এবার দেখা যাক।


“লোকটি ছিলো(৪)/আর দশজন(৩)/লোকের মতোই(৪)/খুব সাধারণ(৪)
আকারে ও(৪)/বেশভূশাতে(৪)
দোহারা তার(৪)/শরীর জুড়ে(৪)/লেপ্টে ছিলো(৪)/বাঙারপনা(৪)
(লোকটি-আনিসুল হক)


এদিকে হায়(৪)/আমার নিজের(৪)/রসদ ফুরায়(৪)/অবশেষে(৪)
তবু আমি(৪)/ভয় পাই না(৩)/ফুরায় না তো(৪)/মনোবল(৩)
(একটু আরো কষ্ট সয়ে-শাসুর রাহমান)


এ দুটি উদাহরণের ১মটিতে আমরা দেখি চরণের মাঝখানে (আর দশজন) ৩ মাত্রা হওয়া সত্ত্বেও ৪ মাত্রার মূল্য নিয়ে পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ২য়টিতে দেখি চরণের মাঝখানে (ভয় পাই না) ৩ মাত্রা হওয়া সত্ত্বেও ৪ মাত্রার মূল্য নিয়ে পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


এর কারণ কী? এর কারণ হলো-
১) শব্দের শুরু থেকে পরপর ৩টি বদ্ধাক্ষর থাকলে এর উচ্চারণকাল স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশের উচ্চারণকালের সমান।


২) শব্দের শুরু থেকে পরপর ২টি বদ্ধাক্ষর এবং পরে ১টি মুক্তাক্ষর থাকলে এর উচ্চারণকাল স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশের উচ্চারণকালের সমান।


তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা প্রথম যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
শব্দের শুরু থেকে পরপর ৩টি বদ্ধাক্ষর থাকলে অথবা ২টি বদ্ধাক্ষর ও ১টি মুক্তাক্ষর থাকলে স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার মূল্য পায় এবং পূর্ণ পর্ব হিসেবে মেনে নেয়া যায়। তবে শর্তটি মনে রাখতে হবে ৩টি হোক আর ২টি হোক বদ্ধাক্ষরগুলো থাকতে হবে শব্দের শুরু থেকে পরপর। শুরুতে কিংবা মাঝে একটি মুক্তাক্ষর থাকলে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এরূপ পর্বটি থাকতে হবে ৪ মাত্রার ২টি পূর্ণ পর্বের মাঝে। কারণ, চরণের শেষে হলে অপূর্ণ পর্ব, আর প্রথমে হলে অতিপর্ব হিসেবে গণ্য হতে পারে।


স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-২


“না, কিছু(৩)/হয়নি আমার(৪)/এই তো ভালো(৪)/আছি(২)”


“হায়! তুমি(৩)/করলে এ কী(৪)/ভেবে অবাক(৪)/হই(১)”


এ উদাহরণ দুটিতে “না” এর পর কমা বসে একটু সময় নিয়েছে। আবার “হায়” এর পর বিস্ময় চিহ্ন বসে একটু সময় নিয়েছে। এরকম যতির কারণে যে সময় ব্যয় হয় তাতে ১ মাত্রার ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। ফলে ৪ মাত্রার মূল্য পায় এবং পূর্ণ পর্ব ধরা হয়।


তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ২য় যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
কোনো পর্বে ব্যবহৃত অক্ষরের পরে কমা অথবা বিস্ময় চিহ্ন বসার ফলে যে বিরতি পড়ে তার জন্য ১ মাত্রা যুক্ত হয় এবং পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহার করা যায়।


স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-৩


শিল্পকর্মে(৪)/আস্থা ছিলো(৪)/বলেই ক্ষুধার(৪)/দাঁতে(২)
দীর্ণ হয়ে(৪)/ক্লিন্ন প্রাণে(৪)/পোড়াই আতশ(৪)/বাজি
ঘুমাক তারা(৪)/ঘুমাক সুখে(৪)/নিদ্রা এলে(৪)/রাতে(২)
ঝুলিয়ে কাঁধে(৫)/মরা পাখি(৪)/আমরা ঘুরতে(৪)/রাজি(২)
(সম্পাদক সমীপেষু-২, শামসুর রাহমান)


উক্ত উদাহরণটিতে (ঝুলিয়ে কাঁধে) ৫ মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ৩য় যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
“য়ে” যুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া পদের সমন্বয়ে গঠিত পর্ব ৫ মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে গণ্য হয়।


স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-৪


“ইয়াসমিনের/সঙ্গে তুমি/দিনাজপুরের/বাসে
তুমিও বাড়ি(৫)/যাচ্ছিলে তো/ ইয়াসমিনের/পাশে”
(দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান-সৈয়দ শামসুল হক)


পদ্য লিখে/চরণ শেষে/ না দিই যদি/যতি
তুমি-ই বলো(৫)/পদ্য লেখায়/কী-ইবা এমন(৫)/ক্ষতি


উক্ত উদাহরণ দুটিতে (তুমিও বাড়ি) এবং (তুমি-ই বলো), (কী-ইবা এমন) পর্বগুলো ৫  মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ৪র্থ যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
শেষে ‘ও’ যুক্ত এবং ‘ই’যুক্ত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত পর্ব ৫ মাত্রার হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে গণ্য হয়।


স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম ৩ এবং ৪ এর একই কবিতায় ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ:


“তোমার উপর/আসে যখন/আমার ভীষণ/রাগ
ভাবি তোমায়/আর দেবো না/আমার ব্যথার/ভাগ।
বাকি জীবন/তোমার সাথে/হবে না আর/কথা
দেখবো তোমায়/কাঁদায় কেমন/আমার নীর/বতা।
ডাকলে তুমি/কাছে গিয়েও(৫)/চাইবো নীরব/চোখে
তোমার আমার/বিরোধটা কী/বুঝবে নাকো/লোকে।
বুঝবে তুমি/বুঝবো আমি/জমাট বরফ/মাঝে
বুঝবে আরো/পূর্ণিমা চাঁদ/জ্যাৎস্না হাসা/সাঁঝে।
নীরব মনে/আমার ব্যথায়/আমিই যাবো(৫)/পুড়ে
করব না ভোগ/যেটুকু সুখ/তোমার জগত/জুড়ে।
থাকবে তুমি/তোমার মতো/আমার মতো/আমি
মধ্যিখানে/দাঁড়িয়ে নীরব(৫)/কাঁদবে দিবস/যামী।
(তোমার উপর রাগ-খলিলুর রহমান)


এখানে (কাছে গিয়েও), (আমিই যাবো), (দাঁড়িয়ে নীরব) পর্বগুলো ৫ মাত্রার হলেও ৪ মাত্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


তবে বলে রাখি এসব ব্যতিক্রম তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন উচ্চারণে পতন বা অতিরেক কানে না লাগে। আর এসব ব্যতিক্রমী চাল অহরহ না দিয়ে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করা উচিত। আরও বলে রাখি যারা আমার মতো নবিশ তাদের জন্য ব্যতিক্রমী চালে না যাওয়াই ভালো। ছন্দে যখন পটু হয়ে যাবেন তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা আপনি সহজেই নিতে পারবেন।


আলোচনার কলেবর ছোট রাখার স্বার্থে অল্পসংখ্যক উদাহরণ দিয়ে শেষ করলাম। আশা করি স্বরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে আপনাদের ভীতি অনেকটা কমে এসেছে। এবার চর্চা করতে থাকুন। আলোচনা পাতায় ছন্দবিষয়ক আরও আলোচনা আছে। সেগুলোও দেখতে পারেন। আর কোনো পরামর্শ থাকলে মন্তব্যের মাধ্যমে জানান। কেউ সামান্যতম উপকৃত হলেও তা জানান। আমিও আপনাদের নিকট হতে কিছু শিখতে চাই। আজ এ পর্যন্তই।


সাথে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
১৭-১-২০১৯


কৃতজ্ঞতা: কবি আবিদ আনোয়ার, গ্রন্থ: ছন্দের সহজ পাঠ