ক্লান্ত শরীরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি পার্কের একটি বেঞ্চে
কতলোক পাশে বসল এবং আয়েস শেষে চলে গেল
তাতে কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই আমার
আমি ঠাঁই বসেই রইলাম
চোখটা বন্ধ করে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে উদ্যত হয়েছি
এমন সময় নাকে ভেসে এলো চিরচেনা একটা শরীরী গন্ধ
ভীষণ চেনা
চোখ মেলতেই আতকে উঠলাম আমি
তোমার চোখে-চোখ পরতেই মৃদু কেঁপে উঠলাম দু'জনে
অতি পরিচিত সেই দুটি চোখ
সেই মানবী
কিছু বলার আগেই মুহুর্তেই বিনিময় হলো হাজারো মান-অভিমানের তীর
একি! তুমি এখানে?
পার্কে বসেও স্বপ্ন দেখছি না তো!
হতেও পারে
আজকাল শরীরটা বেশি সায় দিচ্ছে না
না, না, বয়সের ভারে নয়
শূণ্যতার ঘূর্ণিপাকে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছি শূণ্যের আঁধারে
নিজের শরীরে চিমটি কাটতে যাব
হঠাৎ তুমি আমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললে
থাক আর চিমটি কাটতে হবে না
কেমন হয়ে গিয়েছ তুমি?
এই প্রথম তোমায় এতটা গম্ভীর গলায় কথা বলতে শুনলাম
ভেতরটা ওলট-পালট করে উঠলো
যে মুখে সর্বদা ঝরে পরতো মুক্তর হাসি
সে মুখে আজ কিনা গাম্ভীর্যতা
বিষন্নতার চিহ্নরেখা একদম স্পষ্ট
ভাবতে পারছি না কিছু
তা, তুমি এখানে, কিভাবে?
ঐ যে দেখ আমার একমাত্র নাতি, খেলা করছে
গত সপ্তাহেই ওর বাবা-মা এখানে বদলি হয়ে এসেছে
ছেলে ও বৌমা দুজনেই প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা
নতুন পরিবেশে এসে সারাদিন শুধু মন খারাপ করে থেকে
অথচ বলতেও পারে না আমায় একটু বাহিরে নিয়ে যাও না দিদা
ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে জানো
ঠাট্টার ছলে বললে ঠিক তোমার মতই হয়েছে তাই না
সারাক্ষণ গোমড়া মুখে থাকবে তবুও মুখ ফুটে কিছু চাইবে না
তোমার এহেন ঠাট্টায় বিচলিত হওয়ার কিছু ছিল না আমার
শুধু কোথাও যেন ভীষণ শূণ্যতা অনুভব করলাম চরমভাবে
হ্যা, এমনটাই হয় তো হওয়ার কথা ছিল
সবকিছু হবে আমার মত
অবিকল আমার মত
হয় নি শুধুই আমার কারণে
যাই হোক তুমি কেমন আছো-তোমার স্বামী…
আমার দিকে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলে তুমি
মুখের ভাষা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও চোখের ভাষা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না
চোখের কোনায় ঠিকই ভেসে উঠলো আমার প্রতিত্তোরের ভাষা
বুঝতে আর বাকি রইলো না যে
তুমি এখন অব্দি আমার অব্যক্ত কথার দাবানলে পুড়ে চলেছ অবিরত
তোমার মৌনতার মাঝে লুকিয়ে আছে
আমার প্রতি অজস্র ক্ষোভ, ঘৃণা আর মান-অভিমান
পবিত্র হৃদয়ের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের বিভীষিকাময় অধ্যায়
যার রূপকার কেবলি আমি
অই অবেলায় তোমার এমন মলিন চেহারা দেখতে হবে তা কখনো ভাবি নি
সহসায় মনটা পরম অস্থিরতায় ভরে উঠলো
প্রশ্রয় পেতে চাইলো সাহসের মেরুদণ্ড
খুব ইচ্ছে করছিল সজোরে চেপে ধরি তোমার দুটি হাত
হয়ে উঠি বেয়ারা
ভুলে যাই বয়সের ভার
ভেঙে দেই সমাজের শৃঙ্খল
দু'হাতে আদর করে ভুলিয়ে দেই চাপাকান্নার দিনগুলি
বাহুডোরে বেঁধে নির্দ্বিধায় আজ চিৎকার করে বলি
একজন অসম্পূর্ণ মানুষের অব্যক্ত সব কথা
বলি, তুমিই আমার সৌমিতা
সময়ের সাতকাহনে হারিয়ে যাওয়া
আমার নদীর পাড়ের সেই মেয়েটি
আমার সুপ্ত মনের সুখের তমোমনি
তুমিই আমার অপরিণত প্রেম
আমার শূণ্য জীবনে বিরহের গল্পকথা
একজন অসম্পূর্ণ মানুষের না পাওয়া সম্পূর্ণা
আমি শুধু তোমাকেই ভালবেসেছি
সৌমিতা
চলো আবার নতুন করে শুরু করি আমাদের শুরু না হওয়া গল্প
ঝেড়ে ফেলি দুজনার অসম্পূর্ণ জীবনের অতীত
আমার সাহসের মেরুদণ্ড সোজা হলো ঠিকই
কিন্তু বড়ই অসময়ে
২২ টি বছর পরে
১২ই ভাদ্রে
শুধু তুমি আমি আজ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে
ভুল মৌসুমে
বিধাতাও তাই মেনে নিলেন না এমন অসম আকুতি
মুহুর্তেই বদলে গেল শুভ্র আকাশের প্রতিমূর্তি
শুরু হলো ভাদ্র মাসে অঝোর বৃষ্টি
নাতির হাতটি ধরে নিরাপদ আশ্র‍য়ে চলে গেলে তুমি
নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল সমস্ত আবেগ
অসাঢ় সাহসের মেরুদণ্ড
বিধাতার সতর্ক বার্তায় কেটে গেল সব মোহ
ফিরলাম বাস্তবতায়
তিরিশোর্ধ সনদ যেমন সরকারের কাজে আসে না
তেমনি অবেলায় চাওয়া অধিকারেরও কোন নাম হয় না
কেউ কাউকে দেবার মত অবশিষ্ট থাকে না আর
কিছু মানুষ অনুভবেই থেকে যায় সর্বস্বজুড়ে
যদিও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি
আজও দুজনার একান্ত ইচ্ছে ও অনুভূতি এক
আজও তুমি প্রতীক্ষায় থাকো আমার অব্যক্ত আহবানে সারা দিতে
তবুও সময়ের সাতকাহনের নেই তো কোন পরাজয়
তুমি হয় তো জানো না সৌমিতা
তোমার শূণ্যতায় জ্বলে পুড়ে অঙার হয়ে
এখন আমি অনেকটাই পরিণত একজন মানুষ
কথাতেও এসেছে পরিপক্কতা
শুধু সময়টা আজ প্রতিকূলে
অনুভূতিগুলো পূর্ণতা পেয়েছে বড্ড দেরিতে
ভুল বয়সে
সৌমিতা, তুমি জানো নিশ্চয়ই
জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া যেমন পরিপূর্ণতা পায় না
তেমনি সব মানুষই সবদিক থেকে পরিপক্ক হয় না
এমন কিছু মানুষ আছে যারা আমৃত্যুই থেকে যায়
অপরিণত…অসম্পূর্ণ…
বেলা শেষে যতভাবেই নিজেকে আবিষ্কার করুক না কেন
কিছুতেই আর পেরুতে পারে না শূণ্যতার বৃত্ত
বেঁচে থাকতে হয় সবার অগোচরে
আপন সত্ত্বাকে আড়াল করে
স্মৃতিজুড়ে থাকে শুধু কিছু নাম
কিছু চিরচেনা মুখ, কিছু হাসি
সৌমিতা, বলতে আজ বাঁধা নেই
তোমাতেই হয়েছিল যে আমার শুরু
তোমাতেই করতে চাই শেষ
তুমিই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র রথী
আমার, সুখের জোনাকি।