করিডোরে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখা যায়।
আমি চাঁদ দেখি না।
বাইরে বেরোলে পথ পেরুলে আসমানী রঙের মুক্ত আকাশে অনেক তারা দেখা যায়।
আমি আকাশ কিংবা তারা কোনোকিছুই দেখি না।
সবচেয়ে উঁচু কিনার থেকে কেউ কেউ দূরের পাহাড় দেখে।
পাহাড়ে নাকি সূর্য ডুবে যায়।
পাহাড়টা সারাদিন পিরামিডের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আর
সন্ধ্যেয় নাকি সূর্যের কাছে হেরে যায়।
পাহাড়টা নাকি নড়ে না।জায়গা থেকে সরে না।
ঝড় হলে কাঁপেও না।বিপদ এলে ডানা মেলে উড়েও না।
পাহাড়টার বোধহয় যাবার কোনো জায়গা নাই।আমার মতো।
তাহলে কোত্থেকে এসেছে সে এখানে?
সে যখন এসেছে তখন তার বয়স খুব কম ছিল শুনেছি।
এখন বুড়িয়ে গেছে।নড়তে না পারাই স্বাভাবিক।
আবার মাঝেমাঝে প্রচণ্ড জোছনায় পাহাড়কে জিততে দেখা যায়।
অন্ধকার মায়াবী পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ ক্লান্ত এক যুবক যেন দাঁড়িয়ে আছে।
তার দীর্ঘনিশ্বাস,তন্দ্রাভাব ঘোর,তার অচেনা ভ্রুকুটি প্রকাশ পায় রাতের আলোয়।
আচ্ছা,পাহাড়ের কি কোনো প্রেয়সী আছে?
সে কি কাউকে ডাকে?
কাউকে ডাকলে কি তার মন শিহরিত হয়?অভিলাষী পুলক জাগে!
আমি তো জানি পাহাড়ের মন বলে কিচ্ছু নাই।
তাহলে সে কার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইছে সেই-
মিশরীয় সভ্যতার কালেরও আগ থেকে!
সে কারে ডাকে?কি চায়?কার কাছে চায়?কেনো ডাকে?
আর ছোট্ট একটা ঝোপ থেকে ঝিঝিপোকা ডাকে।অবিরাম।
এই পোকাটা আবার কাকে ডাকে!
ঝিঝিপোকা তো পাহাড়কে দেখতে পায়না।সে অন্যকিছু দেখে।
ঝিঝিপোকা বোধহয় আমাকে দেখে।
আমাকে দেখার কি আছে!আশ্চর্য!
আমি একটা মানুষ মাত্র।
ঝিঝিপোকা এই ডাকটা শিখলো কার কাছ থেকে?
আমার কাছ থেকে কি?
কনক্রিটের দেয়াল গুলো শান্ত।ডাকাডাকি নাই।
নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে।এরাই ভালো।ডাকে না।এরা মানুষের দিকে চেয়ে থাকে শুধু।
সব মানুষ ব্যস্ত।কেউ পড়ে,কেউ খায়,কেউ আঁকে,কেউ দেখে,কেউ ভাবে।
কেউ কথা বলে,কেউ গান গায়,কেউ ছুটে চলে এই মোড় থেকে ঐ মোড়।
কেউ হাসপাতালের বেডে পড়ে পড়ে মরে।
পৃথিবী তারে বিদায় জানাবার আয়োজন করে যা কেবল সে-ই দেখে।
সে কাঁদে,সে হাসে।আল্লাহ তায়ালার দরবারে সে শান্তির মরণ চায়।
কেউবা মানুষের পকেট মারে,ছিনতাই করে এই আধপোড়া পৃথিবীর অসহায় কোনো মানুষের কষ্টার্জিত জমানো টাকা।
কেউবা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে।
তার এই দুনিয়ার খেয়াল থাকেনা।সে আকাশ দেখে সাতটা।জমিনও দেখে সাতটা।সাতটার মধ্যে কোন জমিনে পা রাখবে সেটা ভেবে বিষম খায়।আর একসময় মাতাল হয়ে গালিগালাজ শুরু করে।যেনো আল্লাহ তায়ালা তাকে মাতাল হয়ে গালি দেয়ার জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
কেউ দোকানে বসে থাকে।বেচাকেনা করে।টাকা কামায়।
বাসায় এসে পানির কল ছেড়ে দিয়ে ওযু করে।
তার সারাদিনের নামাজ কাযা হয়ে গেছে।দোকানে প্রচন্ড ভিড় ছিলো আজ।ব্যবসা ভালো হয়েছে।
ছেলের এই মাসের খরচটা আগেভাগেই উঠে গেছে।
এসব ভেবে সে মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানায়।
কেউ কাঁথা সেলাই করে।তার নাতী হবে।অনাগত নবজাতক নাতীর জন্য রাত-দিন অবসর পেলেই কাঁথা সেলাই বুনে সে গৃহিণী।আর ভাবে তার নাতীর নাক নিশ্চয়ই তার মতো সুন্দর হবে।
কেউ বই পড়ে।ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
অনিচ্ছায় যারা বই পড়ে তারা ছাত্র।স্কুলের কিংবা কলেজের।
তাদের বলা হয়েছে না পড়লে না খেয়ে মরতে হবে।
তাই তারা জোর করে পড়ে।
এই পৃথিবীতে খাওয়াটাই মানুষের প্রধান কাজ।
কেউবা প্রেমিকার জন্য কবিতা লিখে।
প্রেমিকার জায়গায় সমাজকে নিয়ে আসে কেউ কেউ।
কলমের খোঁচায় রাষ্ট্রকেও বদলে দিতে দেখা যায় অনেককে।
অনেকে মিছিল করে,স্লোগান ঠিক করে।
কেউবা ভিডিও বানায়।নেটে আপলোড করে।এরা সেলিব্রিটি প্রজাতির মানুষ।
কেউ বিতর্ক করে।এই ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা আছে নাকি নাই।এই বিষয় নিয়ে বাক্যালাপ করে।'স্রষ্টা নাই।পৃথিবী এমনি এমনিই হইছে'বলে মুচকি হাসি দেয় কেউ কেউ।এই পক্ষে যুক্তি দেয়।যেনো স্রষ্টাকে অস্বীকার করে সে মহাভারতকে শুদ্ধ করে ফেলছে!
আরো আছে।কেউ নাচে,কেউ চিৎকার করে।কেউ গ্রামের বাড়িতে যায়।কেউবা অন্ধকার-আলোর মাঝামাঝি অবস্থানে বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় রাজপথ।তার বয়স কম।তাই সে এই আকাশের মতো বিশাল হতে চায়।বেচারা ছোট্ট শিশু বোঝেনা যে সে অচিরেই শিকলে আটকে যাবে।
কেউ কৃতকর্মের মানে বোঝেনা।না বুঝেই কাজ করে যা খুশি।
কেউ স্বপ্ন দেখে।কেউ মাকে নতুন শাড়ি কিনে দেয়ার কথা ভাবে।
কেউ ভাবে কিভাবে ওপাশের জমিটা দখল করা যায়।নিজের ছেলেমেয়ের থাকার জায়গা দেয়ার অভাব তার।
কেউ নিজের পাপ ঢাকে।বৃথা চেষ্টা করে ভালো সাজার।
তারা জানেনা যে,পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে মহামানব ব্যতীত পৃথিবীর
সব সাধারণ মানুষ পাপ করেই আসছে।এইটা লুকানোর উপায় নাই।
কেউবা জ্যামে আটকে থাকে।কর্মব্যস্ততায় যে সারাটাদিন অফিসে আটকে ছিলো।সে গলা থেকে টাই খুলে ফেলে।হঠাৎ তার মনে ভয়-সন্দেহ আর প্রশ্ন সে যে গলায় টাই পরে এইটা কি জায়েজ?নাকি নাজায়েজ!
কেউ মিথ্যা কথা বলে।কেউ বদনাম করে।কেউ খুঁচিয়ে খুঁটিয়ে দোষ খুঁজে অন্যের।
আর কেউ কেউ ক্ষমতা বাড়ায়।আধিপত্য বিস্তার করাই এদের জীবনের মূল লক্ষ্য।
কেউ হত্যা করে।
মানুষ হত্যা করে।
পশু হত্যা করে।
সময় হত্যা করে।
স্বপ্ন হত্যা করে।
আশা হত্যা করে।
গল্প হত্যা করে।
কেউ আগুন নেভায়।কেউ দৌড়ে পালায়।কেউ কেউ বাঁচতে চায়না।আত্মহত্যা করে।জাহান্নামে যাবে জেনেও শয়তানকে নিজের বন্ধু বানায়।খোদার প্রতি তার অনেক অভিমান।সে নিজেকে দায়ী করেনা।খোদাকে দায়ী করে।
চারিদিকে আগুন।মনের আগুন।বোনের আগুন।ফাগুন রাতের উত্তাপ আর গরম হাওয়া।সবাই ভয় পায়।সহ্যসীমা কমে যায় মানুষের।
মানুষ বসন্ত চায় কিন্তু ফাগুন চায়না।ফাগুন ছাড়া বসন্ত।
উত্তাপ ছাড়া আগুন চায়।
মানুষ এমনই।সে কি চায় নিজেও বোঝেনা।না বুঝেই চায়।
পাহাড়টা কি বুঝে কিছু?
রাতের আকাশ,রাতের চাঁদ,রাতের তারা,সন্ধ্যের মায়া,গোধুলির ভালোবাসা,নিশিভোরের জমিন,চুপটি করে ঝিমানো আসমান সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসে।
সব যেন খাবি খায় কোনো নদীর জলের স্রোতে।
পাহাড়টা দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকে।নিশ্চল।
আর নিরব সুরে,যাপিত লালিত কন্ঠে অমায়িক ডাক ডাকে।
কারে যেনো ডাকে।
অনেক মানুষ খোদাকে ডাকে।প্রার্থনা করে।যাতে ফাগুন ছাড়া বসন্ত আসে।করুণ সুরে দোয়া পড়ে।মহা জ্যোতিষ্কের আলোয় অবগাহন করে।ঠিক পাহাড়টার মতোনই।
প্রাচীনকালে নীলনদে বাঁধ দিয়ে কৃষকেরা যখন কৃষিকাজ করতো,তখন-
তারাও নাকি গান গাইতো।আকুল করা সুরে।মোহনীয় কন্ঠে।
সারাদিন মাঠে কাজ করতো আর রাতের বেলা নাকি নদীর তীরে বসে থাকতো।তখনই গাইতো।ডাকতো।
তখনও জোছনা ছিলো।চাঁদ ছিলো।তারা ছিলো।স্বপ্ন ছিলো।ভালোবাসা ছিলো।
এইসব প্রাচীন জনপদের কাছ থেকেই কি পাহাড়টা ডাকাডাকি শিখেছে?নিরবে এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা শিখেছে?
এরও অনেক আগে যখন বেহেশত থেকে মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানো হলো;তখন থেকেই নাকি পাহাড়টা ডাকে।এক জায়গায় দাঁড়িয়েই। আবহমানকাল ধরে আদম-হাওয়ার সন্তানেরা সে ডাক শুনে।
শুনে আর চোখ বুজে ভাবে।কাকে ডাকে এই পাহাড়?কি বলে?কি চায় ও?
অনেকে চোখের পানি ফেলে সে ডাক শুনে।কিন্তু পাহাড়ের কান্নার,পাহাড়ের প্রার্থনার অর্থ অজানাই রয়ে যায়।
এই পৃথিবীর আলো আঁধার,অনুরাগ-আশা,আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানার মাঝেই পাহাড় ডাকে।
আমিও জন্ম থেকেই পাহাড়ের মতন ডাকছি।