১৯৮৫ ইং সাল।
কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে জেলখানার আশপাশে
লেকের এপার-ওপার জনতা আর সাংবাদিকের ঢল
ঢল আদালত প্রাঙ্গণেও।
আজ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী
ফ্যাসিবাদী সাদা মানুষের হাতে
ক্ষমতাসীন জল্লাদের হাতে
একজন সত্যবাদী মুক্তিবাদী বর্ণবাদ বিরোধী
কৃষ্ণাঙ্গ কবি-কালো কবি অসহায় মানুষের হৃদয়ের কবি
বেঞ্জামিন মলেজের ফাঁসির রায় ঘোষণার দিন।


হাতে হাতকড়া, হাতকড়ার সাথে শিকল।
রাইফেল বন্দুক ওয়াটকি আমলা সিপাই নির্বাহী
অসংখ্য শ্বেতাঙ্গ কুকুর ডানে বামে পিছনে সমুখে।
কবিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতের দিকে
জনতার গতি অসহায় মানুষের ঢল
আজ তাই আদালত অভিমুখে।
ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা, বিশ্ববাসীর দৃষ্টি
কবির দিকে। আর কবির দৃষ্টি
প্রিয় দেশ, দেশের মানুষ আর বিশ্ববাসীর বিবেকের দিকে।


চলন্ত গাড়ী স্থির
সারি সারি দোকান বন্ধ, ফুটপাত উজার কাল রাতে
ভিক্ষুকের থালা রয়ছে ঝোলা বন্দী
মসজিদ মন্দির গির্জার দুয়ার আটা
শিশু শিখেনি পাঠশালার পাঠ, শিক্ষক বসেনি চায়ের কাপে
রন্ধশালে হয়নি বাঁটা কোটা সকলেই আহত এক বেদনাতে।
সবারই ঝোঁক আদালতের রাস্তায়, বাতায়নে ঠাঁসাঠাসি চোখ
সকলেই আজ কবির লোক, কবিকেই ভালবেসে ফিরে পেতে চায়।
সকলের একই দীর্ঘশ্বাস যদি কবির কিছু হয়?
বাতায়নে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি মানুষ অসংখ্য নারী ডাগর চোখ
শিকল পড়া ঐ দীঘল কবির দিকে।


বেঞ্জামি উঁচু মাপের একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিপাগল কবি
গায়ে তার জেলখানার নোংরা পোশাক হাত পায়ে বেড়ি
তবুও কী উচ্ছল কী উজ্জল সুদূর বিসারী মুক্তির স্বপ্নে
আশায় বুক ভরা অকুতভয় এক মানুষ।
ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল বড় উষ্কখুষ্ক আজ
নিজ দেশ নিজ দেশের প্রিয় মাটি তবুও বন্দী
তবুও তাঁরা দাস।
সেই বেদনা ক্ষোভ দীর্ঘশ্বাস
বুকে নিয়ে এগিয়ে চলছে কবি
সাথে পিচঢালা পথ আর আফ্রিকার কালো মানুষ।


আদালত এজলাসের সামনে জনতার ঢল স্থির
কৃষ্ণ সাগরের মত অসংখ্য কালো চোখ
কালো মানুষ আর শ্বেতাঙ্গ কুকুরের ভিড়।
কত আনাগোনা হাঁক ডাক আমলা চাপরাশির।
দুপুর গড়িয়ে যায় যায় শেষে
হাত পায় বেড়ি পড়া কবিকে আনা হলো এজলাসে
শ্বেতাঙ্গ শকুন পাল ছুটে এলো কৌশলী বেশে
কবির কৌশলীরাও দাড়াল এক পাশে।
প্রধান রেজিস্টার অভিযোগ পড়ে শুনাতে লাগলো,


একঃ সাক্ষ্য প্রমাণসহ তদন্তে প্রমাণিত যে, এ খুনি
আমাদের খুবই বিশ্বস্ত মহান এক পুলিশ কর্মকর্তাকে
নিজ হাতে খুন করেছে।
আরো অনেক পদস্থ কর্মকর্তা এর খুনের তালিকায় আছে।


দুইঃ এ কবি নামে রাষ্ট্রদ্রোহী, আবোলতাবোল কবিতা লেখে
সন্ত্রাসী কাজে জনতাকে ক্ষেপীয়ে তোলে
সরকার ও তার সমর্থকদের বিপক্ষে
নোংরা মানুষগুলোকে একত্রিত করে বিপ্লবের নামে
একটা রক্তাক্ত ইতিহাসের জন্ম দিতে চায়।


তিনঃ এ মস্তিষ্ক বিকৃত, নেশায় করেছে এর বিবেক ক্ষয়
তাই সম্মানিত শ্রেণীর শ্বেতাঙ্গদের কবলে থাকা আবাদী জমি
কৃষ্ণাঙ্গ বাস্তুহারা কালোদের মাঝে সমান ভাগে দিতে চায়।


চারঃ এ সরকার ও আমাদেরকে স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী
সাম্রাজ্যবাদের গোলাম বলে গালি দেয়
সংবিধান ও পার্লামেন্টের সমালোচনা করে
বিশ্ববাসীর কাছে মিথ্যে নালিশ জানায়
আঙ্গুল উঁচিয়ে রক্তচোখে শান্তীপ্রিয় মানুষদেরকে ভয় দেখায়।


পাচঃ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আফ্রিকা
একটা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হোক
গণতন্ত্র ধ্বংস হোক, মানবতা বিপন্ন হোক
সাথে আন্তজাতিক মহলে আমাদের সুনাম ক্ষুন্ন হোক
সে মর্মে সে এবং তার সহযোগী অনেকেই
দেশ বিদেশের শত্রুদের সাথে গোপনে ষড়যন্ত্র করে চলছে।


উক্ত অপরাধ সমূহের ন্যায় বিচারার্থে  
এবং দেশের সাম্য, স্বাধীনতা ও শৃংখলা রক্ষার্থে
দেশের সাংবিধানিক ধারা মতে
আসামী বেঞ্জামিন মলেজকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল।
সাথে তার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত
তাকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে রাখার আদেশও দেয়া হল।
কিছু মানুষ এ রায়ের বিপক্ষে
কিছু অমানুষ পক্ষে চিৎকার করে উঠল।
পুলিশ পেটরা বাহিনীর কঠিন নিরাপত্তায়
কবিকে আবার জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।


কিছু সাংবাদিক কিছু মানুষ মিথ্যা প্রয়াসে
ভালবাসার আবেগে দৌড়ে কিছুদূর এগিয়ে গেল।
তারপর সব ফাঁকা মনে হল।
কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থেকে
চোখ মুছে ঘরে ফিরে গেল। তারপর
বিশ্ববাসীর মতামত ও সাহায্যের দিকে চেয়ে রইল।


২৮ অক্টোবর/১৯৮৫, মধ্য রাতের গভীর আঁধারে
জনতার ঘুমের আড়ালে, বিশ্ববাসীর মতামত উপেক্ষা করে
কবিকে নির্মম ফাঁসি দেয়া হল।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে একটা বাতাস উঠে
সারা শহর অলিগলি পাহাড় পর্বত অরণ্য গিরি
মরু সাগর পাড়ি দিয়ে বিশ্ববাসীর দুয়ারে পৌঁছে গেল
চেনা চেনা এক কণ্ঠ, কিছু শব্দ-
‘আমি বলেছিলাম না? আমি মরর না।
কবি ও দেশ প্রেমিক কখনো মরে না, তাঁদের মৃত্যু নেই
অন্তত কোন জালিমের জুলুমি তরবার আর ফাঁসির রশিতে।
আমিও কবি। দেশ আর দেশের মানুষকে ভালবেসে
মৃত্যুকে উজিয়ে এসেছি, এই দ্যাখো তোমাদের কাছে।
এখন থেকে তোমাদের পাশেই থাকব, কাছেই রব
নানা নামে নানা ভাষায় নানা জাতিতে রূপান্তরিত হব
মিছিল মিটিং পোষ্টার ফেস্টুনে-পতাকায়
আমি শুধু আফ্রিকী নয়, বিশ্ববাসীর গল্প কবিতায়
প্রতিবাদের নতুন ভাষা হব, আশা হব, কবি হব।
গোলামের শিকল পড়া কোন লাশ রূপে নয়।
আর কোন মৃত্যু আর কোন দেশ নেই আমার
আমি এখন মৃত্যু আর দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে সবার।
তবু আমার প্রথম জন্মভূমি প্রিয় আফ্রিকাবাসী
আর মা কে বলছি,
তোমারা আঁখি মুছে ঘরে ফিরে যাও, মুখে ফোটাও হাসি
এই যে তোমাদের সেই ছোট্ট উঠোন, খেজুর বাগান
গাছের ছায়া, গমের ক্ষেত, আলের কিনার, ঢালু পাহাড়
ঝর্নার ধার্‌,গলির মোড়, পার্কের পাশ, বস্তির কাছ
অথবা দিগন্ত ছুঁয়ে হেঁটে যাওয়া সেই আমি
আজ ছাড়িয়ে গেছি বিশ্ব সীমা রেখা।
এখন সব মাঠ সব ঘাট চায়ের দোকান গমের ক্ষেত
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নাটকের মঞ্চ
আদালতপাড়া ফুটপাত রাজপথ পার্কের বেঞ্চ
সব রাখাল সব মজুর সব বয়সী দুখী মানুষের সাথে
আমারে পাবে দেখা।
আর প্রিয় তুমি পাবে একা চাঁদ ওঠা কোন রাতে।‘
শব্দ থেমে গেল।


তাঁর লাশের সৎকার শেষে
অশ্রুত কালো মানুষে দল দাঁড়াল গিয়ে
এক কালো পাহাড়ের কাছে।
তারপর একজন বলে ওঠল
এ ভীষণ অন্যায়! আরেকজন এ কঠিন অত্যাচার!
আরেক জন এ ধর্ম হত্যার সামিল!
তারপর সমস্বরে কয়েক জন, এ আমরা মানি না
এমন শুধু পাপ নয়, এ মহাপাপ।
এমন পাপ আর পাপীদের মেনে নেয় যায় না।।
একজন শিক্ষক গ্রীবা বাড়িয়ে বলে ওঠল
আমিও, এ পাপ মেনে নিতে পারি না কিছুতেই।
আমার ফেলে আসা ক্লাস, ডাইরি, নোটবুক
ও সবের কাছে ফিরে যাবার আগে
এর একটা সময়োচিত জবাব দেয়া চাই।
অন্যথা আগামী প্রজন্মের কাছে, ইতিহাসের কাছে
বড় ভীরু বড় কাপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকব আমরা।
কিছু ছাত্রছাত্রী বলে ওঠলো, আমরাও
এ কঠিন অন্যায় অত্যাচার
এর একটা জবাব না দেয়া পর্যন্ত
ফিরে যেতে চাইনা পাঠশালা আর পড়ার ঘরে।
এদের সাহসে সাহসী হয়ে কিছু কৃষক শ্রমিক
কল-কারখানা্র মজুর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল
বলল, আমাদের রেখে আসা হালের বলদ
কাস্তে কোদাল লাঙল হাতুড়ী নিড়ানি
শিরা জাগানো এ হাত, আগুন পোড়া শরীর
আর ঘামের শপথ, আমরা এর একটা
জবাব না দিয়ে ঘরে ফিরব না কোন দিন।


কিছু যুবক-যুবতি মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে বলল, এই
আমাদের টগবগে যৌবন আর বিবকের শপথ
আমরা এর একটা সময়োচিত জবাব দেবই।
কিছু নারী বলল, এই আমাদের হাতের বালা
গলার মালা নাকের নোলক ডালার ফুল
ফসল আর মাতৃত্বের গন্ধে পরিপূর্ণ এ শরীর
আজ থেকে মিছিলের জন্যই
জালিমদের হটিয়ে তারপরই সংসারে ফিরে যেতে চাই
অন্যথা আমরাও যে ইতিহাসে অবলা থেকে যাই।


সংগ্রাম চলল, অন্যায় অত্যাচার ফ্যাসিবাদ আর
বর্ণবাদের মূলোৎপাটনের সংগ্রাম।
আফ্রিকার অরণ্য গিরি মরু মাঠ ফসল দিগন্ত
দুলে উঠল, ফুলে উঠল, নেচে উঠল, মানুষের জোয়ার বানে।
আর একজন কৃষ্ণ কবি, কালো কবি, মানুষের কবি
ফাঁসির মঞ্চ থেকে উঠে এসে মিশে গেল
জগত জোড়া মিটিং মিছিল পোষ্টার ফেস্টুন শ্লোগানে।