গোধুলি অস্তবেলা সন্ধ্যার আবির্ভাব
ম্লান অন্ধকার সাঁতরিয়ে আমি পৃথিবীতে এলাম।
উত্তরের শিমুল বনে ক্ষুধার্ত দু’টো কাকা
কা কা করে ডেকে উঠল।
একটা অলক্ষনে কালো বাতাস
আড়াআড়ি সারা গ্রাম হয়ে গেল পার
ঝাউবন কাউবন আম কাঁঠাল বাঁশঝাড়
দুলে উঠল শিহরে উঠল আর
অকাল মৃত্যে ঝরল কিছু হলুদ পাতা
কৃষ্ণচুড়া ভুইচাপা, বকুলের জীবন খাতা।
বাড়ির পোষা রুগ্ন কুকুরটা উউ করে কাঁদল কয়েকবার
আর বিশেষ বেদনায় কুঁকড়ে কেঁদে উঠলেন
জনম দুঃখিনী মা আমার।
সারা রাত একটা ডেকেছিল উঠানে
কালো বাঁদুরের ভীষণ উৎপাত  
আমলকী লীচু পেয়ারা বাগানে।
ভোর না হতেই দু’টো গোসাপ
ভিটে হতে বেড়িয়ে অন্যত্র গেল চলে
গোয়াল ঘরে তিন তিনটে হালের বলদ
পর পর পড়ল ঢলে।
বাবার পুরনো বক্ষব্যাধিটা হঠাৎ গেল বেড়ে
তখনো নাড়িছেঁড়া প্রলাপ বকিছেন মায়
বাতাসের গতিতে সে সব পৌঁছে গেল সারা গাঁয়
লক্ষীছাড়া এক শিশুর আগমন দুঃসংবাদ।
যদিও আমি সদ্যপ্রসূত একান্তই নিষ্পাপ।
তবুও লক্ষী বলে, সোনা বলে অঢেল মমতায়
বুকে টেনে নিয়ে মা আমাকে স্বর্গ সুধা মুখে দেয়।
আমিও কেঁদে উঠি এক মমতার ক্ষুধায়।


কিছুদিন পরই বাবা গেলেন না ফেরার দেশে ফিরে
একবারও এসে বলেন নি, কেমন আছিস খোকা?
আমারে চিনিস নি, কি রে?
ভিটে মাটিটুকু গেল জলকন্যার জলের উদর পূর্তিতে
মাথার উপরের ছাউনি নিষ্ঠুর সাইক্লোন ফুর্তিতে।
আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন মা
তাঁর সকল অসহায়ত্বের জন্য
অর্ধাহার-অনাহারে আমিও উঠি বেড়ে
আমার ক্ষুধারা দিনে দিনে বড় বন্য।
পেটের দায়ে মা ভাঙা থালাখানি নিয়া গেছেন ওপারে।
যেখানে খাদ্য দেবতার মিলে অবশ্যম্ভাবী সাক্ষাৎ।
শুনেছি বিধাতা সব অনাহারীর খাদ্য নিয়ে কেড়ে
ওপারের সেই অমোঘ স্বর্গে করছেন গুদামজাত।
জানি না গরীবের সেখানে আছে কিবা অধিকার?
নাকি এবারের দেবতারাই ওপারে গিয়ে আবার
বড় দেবতায় মিলায়ে হাত গরীবের সব কবিরে সাবাড়?


সেই ছোট্ট ছোট্ট হাজার ক্ষুধার পুঞ্জিবিত উদর আমার
খাই খাই আর করে হাহাকার চিৎকার
ক্ষুধা দোজকের আগুন উৎগীরণ বুকের ভিতর নিরন্তর।
এখন আমি অনেক বড় এক আজব ক্ষুধার রোগী
ইচ্ছে করলে যে কোন মুহূর্তেই
আমার ক্ষুধার উপাদেয় খাদ্য হিসেবেই
খেয়ে ফেলতে পারি ভিটে-মাটি লতা পাতা
মানচিত্র পতাকা সংসদ ভবন সচিবালয়
মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা মন্ত্রী প্রধান মন্ত্রী নেতানেত্রী
আমলার কালবাজারী পুঁজিবাদী গাড়ি বাড়ি কূল নারী
পুরোদেশসুদ্ধো খেয়ে ফেলতে পারি এক লোকমায়
আমার ক্ষুধার কাছে কোন কিছুই এখণ আর অখাদ্য নয়।
না, এসব খেয়েও হবে না, আমার এ মৃত্যুক্ষুধা নিবারণ।
পার্শ্ববর্তী আরো দু’চারটি দেশ তাঁদের তাবৎ জনগণ
আমার ক্ষুধার কাছে বৃষ্টির ফোটার মতন
খুবই নগণ্য তৃষ্ণার এ তিষিত ধন।
সেই গল্পের রাক্ষসের মতন
পুরো তৃতীয় বিশ্বটা দু’ এক লোকমায় খেয়ে এখন
মাত্র দু’ চার মিনিটে করতে পারি হজম।
তারপরও হয়তো ক্ষুধার তৃপ্তি মিটবে না তেমন।


অথচ সেই একই সন্ধ্যায় আমার জন্ম দিনে
কোন এক মন্ত্রী,আমলা বা কালবাজারীর সন্তান জন্মাল
নাচে গানে বাইজীর দেহ বানে পুলকিত ঘর।
সোনার চামিচ মুখে পুড়ে দিতেই পেল টের
গরীবের রক্ত ঘাম কাল টাকার স্বাদ ঢের
প্রথম দিন থেকেই শুরু উদরে ঢোকা তার।


আদর সোহাগ মধু মদে ফুলেল বিছানায়
দিনে দিনে বেড়ে ওঠে সে এক হৃষ্টপুষ্ট অলস শিশু
ক্ষুধা-তৃষ্ণা জ্বরা-মৃত্যু, বেদনা, বেঁচে থাকা কা্রে কয়
সে জানে না ওসবের কিছু।
এখনো তার জন্মদিনে কুড়ি কুড়ি বাতি জ্বলে
সুখসুর সানাই আতশবাজি ফানুস ফেন্সিডিলের বোতলে
ওঠে ঝড় অবৈধ গড়ে ওঠা প্রাসাদ নীচে।
কেক কাকলেট কাটে দেশি-বিদেশী শকুন
‘হ্যাপি বার্ড ডে টু ইউ’ বৈদেশিক আশীর্বাদ তলে
মাটি চাপা দেয় একুশের চেতনার আগুন
আর সেদিনের সে শিশু আজকের যুবক
ফেরে নিষিদ্ধ ভোগ বিলাস বিনাশী অভিলাষের পিছে।


অথচ সেই একই সময়
ভীষণ এক রকম স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা ঘরে আমি
আজব এক ক্ষুধার সাথে লড়ি।
যে ক্ষুধা বেঁধেছে বাসা উদরে আমার সপ্ত দোজখ হতে নামি।
তিলে তিলে নিঃশেষ অন্ধকারে; হাবিয়ার দাহন জ্বালায় মরি
নতুন নতুন অভুক্ত সংযোজনে নতুন জন্ম লাভ করি।
আবার আঁতকে ওঠে আমার বেদনার্ত আঁতুড় ঘর
মহামারি মঙ্গা রাজনৈতিক বিধ্বস্ত আমার দরিদ্র পাড়াখানি।
না ফেরার সেই দেশ থেকে কুকিয়ে কেঁদে ওঠেন মা
আকাশের ছাদ ফেটে জমিনে আসে তার করুণ গোঙ্গানি।
এমনি করে আরো কিছু দিন চলতে দিলে
আমি আমার আগামী কোন নতুন জন্ম দিনের ক্ষুধা উৎসবে
পানপাত্রে ঢেলে রাখা সামান্য মৃত্যু হিসাবে
তোমাদের পুরো বিশ্বটাই নিব এক ঢোকে গিলে।