২০০৫, অপরূপ এক চাঁদনী রাত্রী!
আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন ট্রেন যাত্রী
ঢাকা-চিটাগাং ভায়া লাকসাম-পাহাড়তলী।
অধিকাংশ সময় আমি এ শ্রেণীতেই ট্রেন চলি।
তাতে কিছুটা পয়সা সেভ, হকারের হৈ চৈ
চরস অথবা বিদেশী পারফিউমের চড়া গন্ধ
মিথ্যা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক-নোংরা উক্তি
আর নিজেকে অতি উচু/নিচু ভাবনা থেকেও
দেয়া যায় কিছুটা মুক্তি।


ঝকঝক ঠকঠক বুকের পাঁজর আর লৌহের শব্দ
দূর- দূরান্ত গন্তব্যের দিকে ভাবুক কবির মত
তুলে ধরে উদাস আঁখি করুণ আর্তনাদ
কিংবা আগুন জ্বালা ভালবাসায়
উ উ করে কেঁদে কয়েকবার
জানান দিল যেতে হবে এবার তারপর দে ছুট!
ঢাকা - চিটাগাং লাকসাম সীতাকুণ্ড কদমতলী।


শহর ছাড়তেই আমাদের ট্রেন সে এক অপরূপ দৃশ্যাবলী
মাঠের মাঝে চাঁদ, আলের ‘পরে নূয়ে পড়া ফসলের শীষ
ঝিকিমিকি ঝিলিমিলি দূরের গাঁ, ঝোপঝাড় ছোট্ট নদী
আপন কথা খুলে দিয়েছে চেয়ে আছে রাতের আকাশ
গায়ে এসে লাগা প্রাণ জুড়ানো অবাধ বাতাস
আহ!কত দিন হয়নি দেখা জানালার ওপাশে জেগে থাকা
এমন জোছনা উদাস অপরূপা পৃথিবীর মুখ।
দেখতে দেখতে বাইরের সে দুনিয়া উন্মুখ
আর আলাপনের মাঝে কখন ঘুমিয়ে গেছি যে
জানি নে। ঘুম ভাঙ্গতেই শুনি উপশহরের মসজিদে
লেহিয়া লেহিয়া উঠিছে ফজরের আজান ধ্বনি-
মন্দিরের কাশি ঘোষিছে ভোরের বাতাসে।
উঠে মেসওয়াক করে অজু সেরে নামাজ পড়ি
পাশের প্রবীন লোকটির সাথে এক জামাতে।
তারপর তাসবিহ তাহলিল প্রভুর বন্দনাতে
আরো কিছু সময় থাকি মগন
এমন সময় সীতাকুণ্ড এসে থামে আমাদের ট্রেন।
যাত্রীদের নামার আগেই ফেরিওয়ালারা ছুটে এসে
নানা খাদ্য আর পসরা নিয়ে দাঁড়ালো
আপন আপন ক্যানভাসে।


তাঁদের একজন কাগজ ফেরিওয়ালা বিজ্ঞের মত হেসে
একটা একটা খবরের কাগজ ধরিয়ে দিলো আমাদের হাতে।
আমরা শিরোনাম আর বিশেষ কিছু খবর পড়ছি
এমন সময় পাশের ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন ক্ষোভের সাথে
‘শালার বাঁদরেরা এখন স্বাধীনতা নিয়েও গল্প করে!
শূয়রেরা এটাও জানে না যে, স্বাধীনতা কোন গল্পের
নাম নয়, স্বাধীনতা মানেই নদী নদী রক্ত
লাশের স্তূপ, ভাইহারা বোনহারা সন্তানহারা
সতীত্ব-পতিত্ব সবহারা অগণিত মানুষের
আহাজারি রোনাজারি আর্তনাদ বেদনার অশ্রধার
আর এক ঝাঁক নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধার
বক্ষচেরা সোনালী সূর্য- স্বপ্নের নাম স্বাধীনতা।‘
লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বপ্নের সে স্বাধীনতাকেও
শালা শূয়রেরা এখন গল্প মনে করে, অট্টহাস হাসে
আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হাজার কুৎসা রটনা করে।
আসলে ওদের জন্ম নিয়েই এখন অনেক প্রশ্নোদয় হয়।


তাঁর হাতে ধরা পত্রিকাখানির ‘পর ঝুঁকে পড়ে দেখলাম
বড় বড় অক্ষরে রঙিন করে লেখা- ‘স্বাধীনতার গল্প’।
আমি যদিও স্বাধীনতার মানে বুঝি অতি অল্প
তবু জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
উত্তরে বললেন, শুধু ছিলাম কেনো, এখনো আছি, থাকব
তত দিন যত দিন এ দেশটা না হয় সত্যিকার স্বাধীন।
তারপর অনেক কথা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুঃসাহসিক
কিছু অভিযানের স্মৃতি চারণ আর অশ্রু সংবরণ।
এরিমধ্যে আবার আগের মতই আমাদের ট্রেন
উ উ করে কেঁদে জানিয়ে দিল সীতাকুণ্ড তুমিও বিদায়
তোমাকে ভালবাসা আগুনের ধোয়ার প্রীতি সম্ভাষণ।


শহর ছেড়ে বাইরে আসতেই আমাদের ট্রেন
সেই ভদ্রলোক এক কালে রাইফেলের ট্রিগার টানা
আঙুল ইশারায় একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন,
ঐ তো ঐখানেই আমাদের জাতির সূর্য সন্তান
অসংখ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা- গণমানুষের গণকবর।
আর ঐ অট্টালিকা-বিষণ্ণ আকাশের কাছেই পাক হায়েনা
আলবদর রাজকার শকুনেরা করেছে ব্যবচ্ছেদ
তোমার আমার অনেক মা বোন আর দেশপ্রেমিকের বুক।
এখনো ওখানে বড় অযত্নেই শুয়ে আছে সেসব বরন্যেরা।
কী দিবে তাঁদের বলিদানের প্রতিদান তোমারা?
অথচ রায়ের বাজার শিয়ালবাড়ি বদ্ধভূমির মত
দেশ জুড়ে অসংখ্য বদ্ধভূমি আর ঐতিহাসিক স্থানগুলো আজ
সেই আলবদর রাজাকার আর তাদের দোসরদেরদের কবলে।
ওরা ছলে বলে কৌশলে ওগুলোই নিলামে তোলে
সস্তা দামে হাত বদল কের নিজেদের দখলে নেয়
কুলাঙ্গার প্রজন্মের নোংরা আবাস গড়ে তোলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জেগে ওঠা হাড়গোড় মাটি চাঁপা দেয়
ইতিহাসের টলমল স্রোতগুলো নোংরা নর্দমায় ফিরায়।


এমনি করে নানা বেদনা আর অসহায়ত্বের আলাপে
আমাদের ট্রেন পাহাড়তলী এসে থামে।
যাত্রীরা আপন আপন ব্যস্ততায় ঘরের টানে নামে।
নামে সেই বীরমুক্তিযোদ্ধা মানুষটিও ধীরে ধীরে
তারপর আন যাত্রীর মত এক সময় সেও মিশে যায়
ঘর ফেরা গাড়ি ধরা যাত্রী আর ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে।
আমি তখনো জানালা পথে ঝাপসা চোখে
ফেলে আশা সীতাকুণ্ডের দূর পথ চেয়ে  
দেখলাম, আমাদের ট্রেন আমাদেরে নিয়ে
ততক্ষণ কদমতলী স্টেশনে পৌঁছেছে গিয়ে।
  
তারপর অনেক কিছু ভোলার মাঝেও
সেই ট্রেনযাত্রী বীরমুক্তিযোদ্ধা তাঁর শেষ করমর্দন
আর দৃঢ় কন্ঠে উচ্চা্রিত কতগুলো সত্যের উচ্চারণ-
‘শালার বাঁদরেরা এখন স্বাধীনতা নিয়েও গল্প করে
শূয়রেরা এটাও জানে না যে, স্বাধীনতা কোন গল্পের
নাম নয়, স্বাধীনতা মানেই নদী নদী রক্ত
লাশের স্তূপ, ভাইহারা বোনহারা সন্তানহারা
সতীহার পতিহারা-সবহারা অগণিত মানুষের
আহাজারি রোনাজারি আর্তনাদ বেদনাশ্রুধার
আর এক ঝাঁক নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধার
বক্ষচেরা সোনালী সূর্য- স্বপ্নের নাম স্বাধীনতা।‘
আজও ভুলি নি, ভোলতে পারি নি কিছুই তার।