চার দেয়ালের বিভীষিকা...


ফাল্গুনের এক বেয়ানে মা’য়ে গরম ভাতে ইলিশ শুটকির ঝোল মাখাই দিছিল;
সেটা ছিল অমৃত; হয়ত মা’র হাত বলেই!
ফৌজে যাবে খোকা! মলিন চেহারায় তাকাই আছিল মা, পারবে তো?
মা’র চোখে রাজ্যের বিভীষণ, হতাশা, অনেক কিছু না পাওয়ার কতগুলো গল্প!
মা জানতো ফৌজ মানেই কোন যুদ্ধের ময়দানে নোটিশ ছাড়া নিহত হওয়া!
ফৌজ মানেই সেফটিকেস অন করা ট্রিগারে চেপে রাখা ক্যামপ্লাজ করা শত্রুর শাহাদাৎ আঙুল!
ফৌজ মানেই প্রতিবেশী কিংবা দূর দেশের দেশপ্রেমিক ফৌজ আর স্বদেশীয় বিদ্রোহীর বুকে ফ্রন্টসাইড টিপের নিশানা!
ফৌজ মানেই কাশ্মীরি রঙিন প্রকৃতিতে ফৌজের ছিন্নভিন্ন দেহ রাস্তায় পড়ে থাকা!
না? এভাবেই ভাবছে ক্যান খোকা?


বাপে দুহাত তুলে মসজিদে বসে আছে ‘খোকার যাত্রা যেন শুভ হয়, যদি সম্মুখ যুদ্ধ বাধে গুলিটা যেন কপালে না লাগে; যেখানে চুমু খেতেন!
আঁচলের খোঁট থেকে মা’য় সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কইলেন ‘ওখানে নাকি ক্যান্টিন আছে, রুটি টুটি কিনে খাইয়ো।
যে সব ছেলেরা কচুর শাক খায়; ওরা কিভাবে সেকেন্ড ডিভিশন পায়?
মেট্রিকের রেজাল্টের পর প্রতিবেশী কেউ খোঁটা দিয়েছিল না কি!
মাঝে মাঝে কথাটা বলে মা ক্রোধে ফেটে যেতেন,
মা বলতে চাইতো ‘দ্যাখ কচুর শাকের গুনেই আর্মাড রেজিমেন্টের পাথরের গ্রাউন্ড পায়ের তলায় ফেটে যাচ্ছে!  
চৈত্র মাসের গরমে রাইফেল-হেভারসেক নিয়ে শেড থেকে শেডে ছুটোছুটি কাঁদা মাটির ছেলেটির, সামনে মা-বাবার মুখে শোনা গর্বিত ভবিষ্যৎ!


মাঝে মাঝে মা’য় সদুর অতীতে নিয়ে যেত খোকাকে,
খোকার জন্মের বছর ৭৪’এ কোন দুর্ভিক্ষ হয় নাই, ওটা ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের বানানো গল্প,
বাপের পাঠানো বেতনের টাকা দিতে অমুক পরহেজগার মেম্বারের গড়িমসির গল্প,
জোয়ার এলে জমির নারাতে চিংড়ি মাছ আটকে থাকার গল্প, খোকার বাপের বেড়াল ভালবাসার গল্প,
গেরামের কারা কারা সুযোগ বুঝে হিন্দুদের সম্পদ সস্তায় কব্জা করেছিল ৭১’এ!  
গেরামে শত শত সুঠাম যুবকের মাঝে শুধু পাগলা ধরনের এক ছেলেই মুক্তিযোদ্ধা!
হায়!
বাকিরা কেন নয়? মা’রে জিগায় খোকা!
মা বলেন, ‘গেরামের সরল সোজা কৃষকেরা ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না!
মা’য় উলটো বলতেন তুই বল খোকা ‘স্বাধীনতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধের মাঝে কোনটা অপূর্ব?
খোকা অকপটে বলে দিত স্বাধীনতা মা!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা’য় নীরবে বলে গেলেন ৭১’এ এক নারী ধর্ষণের গল্প!


সেই খোকা একদিন অভিমানে ফৌজের ঘর ভাঙে! পৃথিবী চার দেয়ালে বন্দি ক্যান?
ছোট্ট একটা জীবনে মানুষের আবেগ বিসর্জন ক্যান?
মানুষের কাছে মানুষ গোলাম ক্যান?
নিঃশ্বাস এত দীর্ঘ ক্যান,
মানুষের মুক্তি নাই ক্যান?
ক্যান?
ক্যান?
খোকা ছুটতে থাকে অজানায়, পেছনে কতগুলো মায়া!
একদিন খোকার বাবা মা’ও হারিয়ে যায় অজানায়, খোকা কাঁদে নীরবে, বিচ্ছিন্ন হয়ে!
খোকার খোকারা এখন ভবিষ্যতের বীজ বুনে স্বাধীনতার চার দেয়ালে বন্দি হয়ে!
যেখানে অধিকার-দ্রোহী হলেই কতগুলো বুলেট ঠুস ঠাশ করে ফুটে উঠে রাতের আঁধারে!
সকালে গল্প সাজায় মাফিয়া!
আঞ্জুমান লাশ নিয়ে যায় শেয়ালে খাবে বলে!
পৃথিবীর বড় বড় জেল খানা এখন খোকার স্বাধীন নগরে!
মা’র ছবি দেখতে দেখতে খোকার দীর্ঘশ্বাস বলে যায় ‘তোমার দেখে যাওয়া জেলখানাটা এখন অনেক বড় মা!


//মুক্ত যাযাবর