কবিতা কি কেবল মাত্রা ও ছন্দের গাণিতিক পরিমাপ? কেবল অলঙ্কারের ব্যাকরণ বা ভাষার কারুকার্য? না, কবিতা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। কবিতা হৃদয়ের এক অনুরণন, যা কখনো নিঃশব্দে, কখনো প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো বয়ে চলে। কবিতা হলো সেই মুহূর্তের ধরা পড়া অনুভব, যা চোখের পাতায় নামে, আবার হঠাৎ হারিয়েও যায়।

আমি একজন ডাক্তার—পেশায় বাস্তব, সংযত, ব্যস্ত। প্রতিদিন রুগীদের শরীরের ব্যথা দেখি, শুনি হৃদয়ের নীরব আর্তনাদ। শহরের বুক চিরে ছুটে চলি—কখনো ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে, কখনো অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে, রিক্সার ঘন্টা আর বাসের হর্নের ফাঁকে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করি অন্য এক জগতে।

কদম ফুল খুঁজতে বেরিয়েছিলাম—মফস্বলের শৈশব স্মৃতিতে কদম মানে প্রেম, কদম মানে বর্ষা। কিন্তু শহরে কদম নেই, বরং কংক্রিট আর কর্কশ ধ্বনি। তবু আজ বৃষ্টি নেমেছে। আমি ছাতা রাখিনি। ভিজতে ভিজতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন শব্দ হয়ে পড়ে আকাশ থেকে। আমি আকাশকে খাতা কল্পনা করি, মেঘকে কালি, আর মনের কথা জলের ভাষায় লিখতে থাকি।

এই লেখাই আমার কবিতা।

তুমি, কদম আর কবিতা—তিনেই আমি হারিয়ে যাই। তুমি যেন কোনো অপ্সরী, কিংবা নীলাকাশের প্রেরণা। কবিতা আমাকে বাস্তব থেকে তুলে নিয়ে যায় ছায়াপথে, যেখানে নক্ষত্রেরা ছন্দে নাচে, আর এলিয়েনরাও অবাক বিস্ময়ে কবিতা পড়ে।

আষাঢ় আসে শুধু বাংলার নয়, হৃদয়ের আকাশে। সেখানে ছন্দ নয়, লাগে অনুভব; ব্যাকরণ নয়, লাগে ভালোবাসার জাদু।

এই কারণেই কবিতা কেবল কাব্যিক কাঠামো নয়—এ এক পরম অনুভব, এক নির্ভুল হৃদয়সংলাপ।

হ্যাঁ, আমি একজন ডাক্তার। কিন্তু আজ এই বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আমি শুধুই একজন কবির আয়না—হৃদয়ের জাদুকর কেউ, যিনি কদমের অভাবেও অনুভবের ফুল ফোটাতে জানেন।

সেদিন সন্ধ্যায় আমি লিখেছিঃ

আজ এই বৃষ্টি কদম তোমাকে দিতে চাই....
তোমাতে কদম ও নিজেরে হারাই....
তুমি কি কোনো অজানা অপ্সরী
নাকি আকাশের কোনো নীল পরী!....
ও আকাশ
আমার এ কবিতায় মিলনও পূর্বাভাস
আষাঢ়ে আষাঢ়ে ছড়িয়ে দাও পৃথিবীরও পরে
যেখানে এলিয়েনরাও আজ কবিতা পড়ে
সূর্যের কাছাকাছি
উত্তাপের লহরে নাচানাচি
ছায়াপথে কোলাহল
নীহারিকায় জল
রূপকথায় আমি আর অচেনা কেউ
আজ হৃদয়ে এ কোন ঢেউ.....
.........

আমার আরো কিছু কথাঃ

কবিতা কী?

কবিতা হলো শব্দের অন্তর্নিহিত সঙ্গীত। এটি কেবল ছন্দ, মাত্রা বা অলংকারের খেলা নয়—বরং কবিতা হলো মনের সেই মুহূর্ত যা ভাষায় ধরা দেয় ঠিক তখন, যখন আবেগ, চিন্তা ও অনুভব এক সূক্ষ্ম বিন্দুতে মিলিত হয়।

কবিতা একদিকে যেমন ভাষার শিল্প, অন্যদিকে তেমনই অনুভবের প্রতিচ্ছবি। এটি হতে পারে গভীর প্রেমের প্রকাশ, সামাজিক প্রতিবাদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চিত্রায়ন কিংবা নিছক আত্মপ্রকাশের এক স্বাধীন রূপ। কবিতা যুক্তি নয়, তা অনুভূতির ভাষা।

কবিতা এমন কিছু, যা সরাসরি বলা যায় না, কেবল অনুভব করানো যায়।

কবিতা ও বাংলা সংস্কৃতি

বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস মানেই কবিতার ইতিহাস। সাহিত্যের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, কবিতা আমাদের জাতিসত্তা, ভাবনা, দর্শন, চেতনা ও সংগ্রামের প্রধান মাধ্যম।

১. লোকজ কবিতা:

বাংলার গ্রাম্য সংস্কৃতিতে কবিতা ছিল গান, বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি। এগুলোর অনেকটাই ছিল কবিতা-ভিত্তিক। কাব্য ছিল শ্রুতিনির্ভর—কবিতা মুখে মুখে ছড়াতো, মনে গেঁথে যেতো।

২. ধর্মচেতনায়:

ইসলামের ইতিহাসেও অনেক কবি রয়েছেন। হযরত খানসা(রা.) একজন সাহাবি এবং কবি ছিলেন। বাংলার ইতিহাসেও ধর্মচেতনায় কবিতার উদাহরণ অসংখ্য।

৩. আধুনিক বাংলা কবিতা ও জাতিসত্তা:

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ—তাঁদের কবিতা বাংলা সংস্কৃতির একেকটি স্তম্ভ। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, নজরুলের বিদ্রোহ, জীবনানন্দের নিসর্গচেতনা—সবই আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।
নজরুলের কবিতা যেমন স্বাধীনতার আগুন ছড়ায়, তেমনি জীবনানন্দের কবিতা আমাদের নিয়ে যায় নীরব প্রকৃতির কাছে।

৪. রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও কবিতা ছিল অস্ত্র।
সালাউদ্দিন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের মতো কবিরা তাঁদের কবিতায় জাতির ইতিহাস লিখেছেন। 'স্বাধীনতা তুমি' একসময় যুদ্ধের চেতনা হয়ে উঠেছিল।

কবিতা এখনও প্রয়োজনীয়। কারণঃ

আবেগকে শুদ্ধ ও মার্জিত করে তোলে।

ভাষার সৌন্দর্য ও প্রকাশ ক্ষমতা বাড়ায়।

কল্পনা ও চিন্তার গভীরতা তৈরি করে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যের শক্তিশালী মাধ্যম।

মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে—সম্মান, প্রেম ও সহমর্মিতার ভাষা হয়ে ওঠে।


বাস্তব আর কল্পনার মাঝে, শহর আর শৈশবের মাঝে, কদম আর হৃদয়ের মাঝে যে সেতু—সেই সেতুই কবিতা।

কবিতা আমাদের আত্মপরিচয়।
যতদিন বাংলা থাকবে, হৃদয় থাকবে, প্রেম থাকবে, প্রতিবাদ থাকবে—ততদিন কবিতাও থাকবে।
আর সে কবিতা শুধু সাহিত্যে নয়, হাসপাতালের সামনের ভেজা রাস্তায় দাঁড়িয়েও জন্ম নিতে পারে।