(১)
ভাষা জন্ম নেয় সহস্র সূর্যের দাহে,
নক্ষত্রের দগ্ধ রক্তে গাঁথা হয় তার প্রথম স্বরবর্ণ!
যেখানে বজ্রের ভ্রূকুটি,
যেখানে দিগন্ত জুড়ে মৃত্যুর পদধ্বনি,
সেখানেই দাঁড়িয়ে উন্মত্ত নর্তন করে ব্যঞ্জনবর্ণের অক্ষরবৃত্ত।
শব্দেরা সেখানে জ্বলে ওঠে মহাজাগতিক বিস্ফোরণে,
অক্ষরসমূহ ছিন্নভিন্ন হয় কালান্তক ঘূর্ণাবর্তে।
নির্বাক শূন্যতার অগ্নিগর্ভে জন্ম নেয় ভাষা,
সময়ের বিপর্যস্ত কক্ষপথে উদ্ভাসিত হয় তার অস্তিত্ব!
নিরেট নক্ষত্রপিণ্ডের মতো ছুটে আসে নিঃসঙ্গ ধ্বনি,
দংশিত গ্রহের উল্কাবৃষ্টি,
নির্লজ্জ সময়ের সাগরতটে বিধ্বস্ত হয় শব্দের তরী।
তবু ভাষা ডুবে না!
ভাষা তো মহাকালের যাজ্ঞবল্ক্য,
তাকে দাহ করলে সে হয় রুদ্র,
তাকে শাসনে বাঁধলে সে হয়ে ওঠে মহাযুদ্ধ!
(২)
নৈরাজ্যের অপশাসনে ভাষার বর্ণমালা ক্ষতবিক্ষত,
স্বৈরাচারী অগ্নিশলাকা ছিন্নভিন্ন করে তার কল্পতরু!
দুর্দিনের ছিন্নমস্তা রাজদণ্ড
ভেবেছিল ভাষাকে করবে নিষ্প্রভ,
যেভাবে নখর দিয়ে আঁচড়ে দেয় রাতের বুক,
যেভাবে বিষাক্ত করতলে মুছে ফেলা হয়
অগ্নিস্নাত প্রতিজ্ঞার গৌরব,
তারা চেয়েছিল শব্দের ভ্রূণ হত্যা করতে,
কিন্তু ভাষা তো অন্তর্জলধি—
সৃষ্টি আর সংহারের মধ্যবর্তী মহাপ্রলয়!
ভাষার শিরায় প্রবাহিত হয় অনন্ত অগ্নি,
তার প্রতিটি ধ্বনি মহাযুদ্ধের মশাল,
তার প্রতিটি বর্ণ যেন বজ্রের রণহুঙ্কার!
যে মাটির শিরায় প্রবাহিত হয়েছিল
বিপ্লবের অগ্নিতরঙ্গ,
সেই মাটি ভেবেছিল, শব্দের শরীরে
জেগে উঠবে না আর কোনো অগ্নিস্নান!
কিন্তু ভাষা কি কেবল শব্দের অনুরণন?
ভাষা তো দুর্বার বজ্রনিনাদ!
ভাষা তো আকাশচুম্বী চেতনাদ্রোহ!
(৩)
সেই যে একুশের রক্তপতাকা,
যেখানে মাটি চূর্ণ হলো, শিকড় উপড়ে গেল,
তবু ভাষা থামলো না,
ভাষা গর্জে উঠলো প্রস্তরবিদীর্ণ বজ্রনিনাদে!
অঙ্গার লেপ্টে থাকা রাজপথ জানে,
নির্জীব অক্ষরও একদিন হয়ে ওঠে
ধ্বংসের আগ্নেয়গিরি!
নরকঘ্রাণী স্বৈরাচারী সত্তা জানে,
ভাষাকে বেঁধে ফেলা যায় না কাঁটাতারে,
যেমন আকাশকে ভাঙা যায় না,
যেমন সূর্যকে কারাগারে পোড়ানো যায় না,
যেমন সমুদ্রকে শিকল পরানো যায় না!
তবু তারা প্রবল,
তবু তারা নেমে আসে লোহিত দণ্ড হাতে,
তবু তারা ছিঁড়ে ফেলে শিকড়ের স্বপ্ন।
কিন্তু ভাষা কি মৃতদেহ?
ভাষা তো কেবল ধ্বংস নয়,
ভাষা মহাযুদ্ধের অতন্দ্র প্রহরী,
ভাষা মহাকালের নিঃসঙ্গ শঙ্খ!
(৪)
যেখানে ছিন্নভিন্ন কঙ্কাল,
সেখানে রচিত হয় নতুন ব্যাকরণ,
যেখানে নিঃশেষ মৃত্যু,
সেখানেই ভাষা জন্ম দেয় নতুন মহাকাব্য!
স্বরবর্ণেরা সেখানে জ্বলে ওঠে উল্কাপাতের মতো,
ব্যঞ্জনবর্ণেরা দাঁড়িয়ে থাকে
নির্মোহ প্রলয়ের লেলিহান শিখায়!
ভাষার জন্য যারা রক্ত দিলো,
তাদের কণ্ঠে এখনো বজ্রগর্জন বাজে—
ভাষা কখনো থামে না,
ভাষা কখনো মরে না!
(৫)
তাই যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে,
শোন—
এই মাতৃভাষার জন্য যারা ছিঁড়ে ফেলতে চায়
শিকড়ের জন্মরেখা,
তারা জানুক—
ভাষার মৃত্যু নেই,
ভাষা হলো রুদ্রতাণ্ডবের শ্বাপদসংগীত,
ভাষা হলো মহাপ্রলয়ের অনির্বাণ অগ্নিশিখা!
ভাষা চিরঞ্জীব, ভাষা অবিনশ্বর!
ভাষা মহাকালের অনন্ত অভিঘাত,
ভাষা ধ্বংসের ঊর্ধ্বে এক মহাশক্তির প্রলয়রাগ!
যুগ যুগ ধরে ভাষা বিদ্রোহের চৈতন্যধ্বনি,
শতাব্দীর অন্তরীক্ষে সে অনির্বাণ—
এক অগ্নিরথের দুর্জয় মহাযাত্রা!