লেখাটি গত  শুক্রবার ২৮/০৪/১৭ ইং দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত -


২০১৩ আহমেদ ফুয়াদ নেজাম মৃত্যুবরন করেন । নিউইয়র্ক টাইমস এবং সি এন এন সংবাদে  নেজামের কাজকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় । নেজামকে বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের কন্ঠস্বর । কিন্তু বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং স্বৈরাচার শাসকের নিকট নেজাম একটি  আতংকের নাম ।
নিগৃহীত এবং নিন্মবিত্ত শোষিত  দরিদ্র মানুষের কাছে  আহমেদ ফুয়াদ নেজাম নামটি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারীত হয় । আহমেদ ফুয়াদ নেজাম সাধারণ শোষিত বঞ্চিত জনসাধারণের প্রতিনিধি যার অধিকাংশ সময় কাটে কারারুদ্ধ অবস্থায় । পুলিশের অবিরাম ধরপাকর , শাসকগোষ্ঠির  নিকট বিভীষিকা নেজামের   জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে  জেলে  । তাই বার বার শাসকগোষ্ঠি যখন তাকে অন্তরীন রাখার ভয় দেখিয়েছে তিনি বলেছেন “যার জীবনের অধিকাংশ সময় কারারুদ্ধ কাটে তাকে আর ভয় দেখানো না হোক  ”।
জীবনের শেষ দিকে আহমেদ ফুয়াদ নেজাম তার কাজের স্বীকৃতি পান । গরীবের এম্বাসাডার তথা মুখপাত্র হিসেবে সম্মাণিত হন । নেদারল্যান্ডের  প্রিন্স  ক্লজ “ইন্টিগ্রিটি এওয়ার্ডে” ভুষিত করেন তাকে । এই মহান  কবির জন্ম ১৯২৯ সালে এক  অতি দরিদ্র পরিবারে নাইল ডেল্টা গ্রামে  । সে গ্রামটি এখনো ইংল্যান্ডের উপনিবেশের একটি ।  ১৭ ভাইবোনের এক বিশাল সংসারে তার বাবা ছিলেন পুলিশ । কিন্তু ফুয়াদের মাত্র ছয়  বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । এরপর নেজামের মা ‘এর সাধ্য ছিল না সন্তানকে নিজের কাছে রেখে প্রতিপালন করার । তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো চাচার কাছে । কিন্তু তার চাচাও তাকে নিজের কাছে রাখলেন না । সেখানে থেকে পুনরায় তার স্থানান্তর হলো এতিমখানায়  । এতিমখানা থেকে বের হবার পরে জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে বহু ধরণের কাজ তিনি করেন । পশুপালক থেকে শুরু করে দর্জি , দোকানের কর্মচারী ,পোষ্টমাস্টার  , এমনকি প্রেসেও কাজ করেছেন । টিকে থাকার অবিরাম সংগ্রামে নেজাম অসফল তা নয় বরং একটা জাতির কাছে নিয়ে এসেছেন আরব বসন্তের মতো একটা সংগ্রামের সমৃদ্ধ জাগরণ । আরব বসন্ত তো শুধু বিপ্লব বা রেনেসাঁ নয় – এ হলো জাগরণ আত্মার । যেখানে জনসাধারণ বুঝতে পারে আত্মার অবিরাম উত্থান আর পতনের কথা । নেজাম যেই জীবনের সন্ধান দেন সে নিজেকে নিজে চেনার জানার । এই জানা এবং উপলদ্ধিটা এসেছে নিজের জীবনের কাছ থেকেই । পরতে পরতে অনুভব করেছেন জীবনের কাঠিন্য । হেরে যান নি – বার বার বুক পেতে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমোঘ বাণীর মতো - জীবনকে হেলায় তুচ্ছ করেছেন –
ভাগ্যের পায়ে দুর্বলপ্রাণে
       ভিক্ষা না যেন যাচি ।
কিছু নাই ভয় , জানি নিশ্চয়
       তুমি আছ , আমি আছি ।
এই অমিতশক্তি নিয়ে নেজাম এগিয়েছেন দুর্বলের পক্ষ নিয়ে । বার বার এসেছে আঘাত –কিন্তু নেজাম হেরে যাননি । এর ফলে তিনি শ্রমিক শ্রেণীর নায়কে পরিণত হন এবং লেখা আরো বেশী রাজনীতি  সংশ্লিষ্ট হয়ে ওঠে । এমনকি যখন তিনি জেলে অন্তরীন ছিলেন তখন আনোয়ার সাদাত টিভিতে তার একটি কবিতার জন্য উপহাস করেন । তাতে তিনি  আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও  গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়েআরো বেশী জনপ্রিয় হন  । ১৯৪৬ সালে নেজাম তার ভাই এর সাথে কায়রো আসেন , ১৯৫১ সালে বৃটিশ নিয়ন্ত্রন এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে রায়টে জড়িয়ে পড়েন ।
১৯৫৯ সালে দলিল জাল করার জন্য তিন বছরের জেল সাজা পেতে হয় নেজামকে । অন্তরীন থাকাকালীন সময় তিনি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন ।
নিন্মবিত্ত শ্রেণিহীন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার কবিতার বাণী গর্জে ওঠে । অনেকটা আগুনের মতো – সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে ” সেই আগুনের অনলবর্ষী সুর জনতার যেনো হৃদয়ের কথা –যে কথা এতোদিন হয়নি বলা । এলিট শ্রেনী সুলতান ,প্রিন্স ,প্রিন্সেস , রাজা বাদশার মতো জীবন যাপন করে অথচ সাধারণ মানুষ মানবেতর  জীবন যাপন করে ।
শাসক শ্রেণীর ভয় তাদের নিয়ে নয় এটি যখন তারা নিশ্চিত তখন নেজাম বলেন “ এই দরিদ্ররাই মিশরের সম্পদ । তারা মেধাবি  । তাদের যেনো অবমূল্যায়ন করা না হয় ”। নেজামের এই উচ্চারণ ছিলো তখনকার শাসক এবং শোসকের বিরুদ্ধে । “ Newly  establishment supreme Council for the Arts “ একটি জাতীয় রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে । তিনি সেই পুরষ্কার জিতে নেন । এবং এই সময় তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয় “Picture from life and  Prison এবং তখনো তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন ।
১৯৬২ সালে জেল থেকে বের হবার পরে নেজামের সাথে অন্ধ গায়ক ইমামের সাক্ষাৎ হয় । ইমাম ছিলেন সুরকার  এবং গায়ক । ফুয়াদ বিন নেজাম গান লিখতেন এবং ইমাম সুর করে গাইতেন । নেজাম তো সবসময়ে পুলিশের তাড়াতেই থাকতেন ।নেজামের গান সর্বসাধারণের কাছে ইমামই পৌঁছে দেন । এসব গানের বাণী এবং সুর ছিলো তেজোদীপ্ত  যা  যুবসমাজের নিকট   তুমুল জনপ্রিয় হয় ।  শেখ ইমামের সাথে নেজাম  মিশরের সবচাইতে দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকায় বাস করতেন ।
এই সময় জেনারেল নাসের  ক্ষমতায় এবং ইসরাইলের সাথে  মিশরের কুটনৈতিক সম্পর্ক বেশ মধুর ।যা সাধারণ জনগনের কাম্য নয় । এবং  দেশের জনগনের অবস্থা মোটেই ভালো নয় । ইজরাইলের সহায়তায় দেশের মানুষ বার বার বঞ্চিত  হয়েছে জীবনের ন্যুনতম চাহিদাগুলো থেকে । দেশের উপরতলার মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় আর জনসাধারণ বঞ্চিত জীবন যাপনের সাধারণ অধিকার থেকে । এই বিষয়গুলো আহমেদ ফুয়াদ নেজাম কবিতায় এবং গানে আনেন । এর ফলে নাসেরের নির্দেশে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয় । তা  স্বত্তেও নেজাম এবং ইমাম জুটি বিরতিহীন ভাবে সমাজের উঁচু শ্রেণীর বিরুদ্ধে কলম ধরা  বন্ধ করেন নি  । তাদের গায়কী , কথা এবং সুরের সেই অগ্নিবর্ষন থেকে সেলিব্রিটি , রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কেউ রেহাই পায়নি ।  


চলবে -