কাল সারারাত ব্রিকলেনের আকাশ ছিল ভারী,
মেঘের প্রচন্ড গর্জন আর,
বাতাসের হিসহিস শব্দে-প্রকম্পিত চারপাশ,
দূরের ফেনিল অশান্ত নীল জলরাশি,
বারবার আছড়ে পড়ছে তটরেখায়,
বর্ণিল শহরটা যেন হঠাৎ মৃত্যুপুরী।
হারিকেনের তীক্ষ্ণ বাঁশির সুরে কোটি প্রাণ-
আর ভয়ার্ত চোখ যেন অপলক,ভাষাহীন।
ক্ষণে ক্ষণে জানলার শার্ষিতে আলোর ঝলকানি-
ডাইনিং কাউচে বসা প্রিয় মানুষগুলোর আতংকিত মুখের সারি-
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় স্মৃতিপথ যেন সুদূর অতীত মনে করিয়ে দেয়।


আমার ছোট্ট দুই বন্ধু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল তাদের পিতামহের কাছে,
আধো বোলে আবদার,গল্প শুনব দাদু,
ওদের কাছে টেনে বলি,রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের গল্প  শুনবি ?
মাথা নাড়িয়ে ওরা সায় দিল,দাদু একটি সত্য যুদ্ধের গল্প শোনাও।
হ্যাঁ,  আজ শোনাব তোদের,
শোষণের বিরুদ্ধে  এক মরনপণ যুদ্ধ -
মা এর জন্য,
                  মাটির জন্য,
                                 স্বাধীনতার জন্য-এ যুদ্ধ।।
              
খুব সম্ভব ১৯৭১ এ নভেম্বর-এর কোন এক বিকেল,
স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত জোয়ানেরা দৃঢ় শপথ নিয়েছে দেশকে মুক্ত করবার,
মন্টু গোমেজের বাড়ীর ছোট্ট বারান্দায় গোল হয়ে বসেছি আমরা ক'জন,
সেদিনও আকাশে ছিল কালো মেঘের ঘনঘটা-
কিন্তু কারও যেন কোন তাড়া নেই ঘরে ফেরার- প্রিয় মানুষটির কাছে,
শক্ত চোয়াল, বজ্রমুঠি আর বুকে তিলতিল করে জমানো অদম্য সাহস,
প্রিয় মানুষের মায়াভরা মুখ আর ভালবাসা এড়িয়ে বুকে জন্মেছে ক্ষোভের চারা,
বেতারে ক্ষণে ক্ষণে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা,
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
কমান্ডার সাহেবের দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ, জয় বাংলা,
বীর বাঙালি অস্ত্র ধর -
বাংলাদেশ স্বাধীন কর।


আমাদের ১৫/২০ জনের একটা দল,
সেখানে বিশু আর সেলিম এর সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হয়,
যদিও সবাই আমরা একাত্মা।
প্রথম অপারেশন গোয়াইনঘাট,
ছোট ছোট টিলা, তার ওপারেই পাকি সেনাদের ক্যাম্প, বেশ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত,
আমাদের সম্বল একটা এলএমজি, গোটা কয় থ্রি নট থ্রি আর ৩০ টার মতো গ্রেনেড,
কিভাবে অপারেশন চালানো হবে, তার পরিকল্পনা চলল সারাদিন,
পাকিদের এই ক্যাম্প ধ্বংস করতে চালানো হবে ত্রিমুখী আক্রমণ,
শুক্রবার গভীর রাত, বুকে ভর করে সাহসী কয় তরুণ এগিয়ে চলল,
সামনে কমান্ডার - ইশারায় তিনদিকে যাবার আদেশ,
হঠাৎ গোলাগুলি শুরু,
অকুতোভয় বিশু গ্রেনেড হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল,
পেছনে আমি মুহুর্মুহু গুলি চালাচ্ছি,
চারদিক থেকে গুলির ফটফট আওয়াজ,
শত্রুদের চিৎকার আর এলোমেলো আক্রমণ,
পাকি শয়তানরা যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে -
তখন বিশুর এক তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল,
আমি শুয়োরেরবাচ্চা বলে বুক উঁচিয়ে গুলি করতে করতে এগোলাম,
মাথায় নেই -আমি কি করছি,
শুধু জানি, আমায় বিশুকে বাঁচাতে হবে,
ও যে মাকে কথা দিয়ে এসেছে,
স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়াবে মায়ের হাতে।
বিশু, বিশু - তুই কোথায়?


হঠাৎ শরীরে প্রচন্ড এক ঝাঁকুনি -
আর কিচ্ছু মনে নেই,
চেতনা ফিরতেই মনে হলো- সারা শরীরে ভীষণ ব্যথা,
উঠে দাঁড়াবার যেন কোন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই শরীরে,
মাথার ভেতরে যেন- গুলির ফটফট আওয়াজ বেজেই চলেছে,
কমান্ডারকে বললাম, বিশু কই ?  
কেউ কোন কথা বলছে না,
একজন বলল,একটু শান্ত হও।
সেলিমকে দেখতে পাচ্ছি না কেন ?
সেলিম কোথায় ?
কমান্ডার বলুন, বিশু আর সেলিম কেমন আছে ?
বিশ্বনাথ শহীদ হয়েছে ?
সেলিমকে ধরে নিয়ে গেছে –
তবে ওরা পিছু হটেছে।


তরুণ, তোমার পায়ে গুলি লেগেছে,
গুলিটা বের করা হলেও প্রচুর রক্ত ঝরছে,
এখন বিশ্রাম দরকার তোমার।
অখন্ড নীরবতা নেমে এলো -
বাতাসটাও অস্বাভাবিক ভারী (দীর্ঘশ্বাস)
কমান্ডার, বিশুর লাশ কোথায় ?
বাইরে রাখা আছে, এখনই দাফন করা হবে।
না, ওকে চিতায় তুলুন, কমান্ডার।
বিশু অপারেশনে যাবার আগে বলেছিল -
তরুণ যদি আমি আর ফিরে না আসি,
তবে তুই আমাকে চিতায় পোড়াস।
কমান্ডার প্লিজ, ব্যবস্থা করুন ওকে চিতায় নেবার।
ঠিক আছে, সব হবে - তুমি বিশ্রাম নাও।


(কমান্ডার, কমান্ডার) বলে দৌড়ে এল সগির,
খুব খারাপ খবর,
পাকিরা আমাদের দিকে আসছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে,
কমান্ডার আদেশ দিলেন, আর দেরি নয় - এ্যাম্বুশ নিতে হবে ।
এখুনি সবকিছু নিয়ে তোমরা পজিশন নাও ।
বাশার, তুমি তরুণকে নিয়ে উত্তরের দিকে এগোও।
আর তোমরা একসাথে আস্তে আস্তে পিছু হটবে।
কিন্তু বিশুর কি হবে,  কমান্ডার ?
এখন এসব ভাবার সময় নেই, তরুণ -
কথা শেষ না হতেই কমান্ডারের নির্দেশ -
আমাদের বেরোতে হবে।
চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা নোনা জল –
যেন সেদিন আরও বেশি নোনা লাগছিল।
পেছন ফিরে তাকাতেই মনে হলো বিশু ডেকে ডেকে বলছে-
ফেলে যেও না আমায় তোমরা,
আমাকেও নিয়ে যা তরুণ।
আমিও যাব তোদের সাথে ,
নতুন অরুণরাঙা সূর্যটাকে ছুঁয়ে দেখব, বিজয়ের পতাকা ওড়াব ,
খুব ইচ্ছে করে মায়ের কোলে একটু মাথা রাখি ।


সেলিমের খোঁজ আর পাইনি, কিন্তু বিশু-
পারিনি তোর কথা রাখতে –
ভেতর থেকেই হয়ত সেই শক্তি সেদিন পাইনি,
বিলেত প্রবাসী এই আমি আজ তাই পালিয়ে বেড়াই - দেশ থেকে,মাটি থেকে,
আর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা প্রিয় বন্ধু বিশুর পড়ে থাকা নিথর শবটা থেকে,
সেলিম,বিশু পারলে ক্ষমা করিস আমায় -
আর আমার মতো সেদিনের -
ক’জন অকুতোভয় কাপুরুষ তরুণদের।।।