(১)


শুক্লা তিথি।
পূর্ণিমা।
চারদিক ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়।
এমন জ্যোৎস্না প্রতি পূর্ণিমাতে আসেনা।
এমন জ্যোৎস্না বহু যুগ পর পর আসে।
এমন জ্যোৎস্না আসে দেবত্বের প্রেমের মাধুর্য সৃষ্টি করতে।
জ্যোৎস্না যেন হলুদ মেখেছে।
একটি অন্ধকার গোয়াল ঘর।
একটু আলো জ্বলে উঠলো।
লন্ঠনের আলো।
ধীরে ধীরে একটু একটু করে আলো বাড়লো।
তারপর রিনিরিনি নুপুরের আওয়াজ শোনা গেল।
অনেকগুলো গরু।
নুপুরের আওয়াজ একটা দুধেল গরুর কাছে এগিয়ে এলো।
মুখ ফিরে তাকালো যেন গরুটা।
স্বয়ং মা লক্ষ্মী এসেছেন দুধ দুইতে।
গোপিনী রাধার মুখ লন্ঠনের হালকা মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত।
মখমলের মত কোমল গাল দুটি তার হলুদ হয়ে এসেছে।
বাতাসে কত সুন্দর একটা গন্ধ, এমন গন্ধ বর্ণনা করা যায় না।
তারপর রাধা দুইতে আরম্ভ করলো।
ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠল ঘড়ায় দুধ।


(২)


হঠাৎ একটা কোমল সুর যেন অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে আসলো।
যেন সেই মধুর সুর খুঁজে ফিরছে রাধাকে যমুনা থেকে বৃন্দাবনের অলিগলিতে।
রাধার মন হঠাৎ যেন কেমন করে উঠলো।
তার শান্ত নয়ন দুটি চঞ্চল হয়ে উঠল।
তার শিথিল দেহ উর্মির ঢেউয়ের মতো গড়তে লাগল আর ভাঙতে লাগলো।
সুর যে দিক থেকে ভেসে আসছে সেই দিকে তাকাল রাধা।
এমন ভাবে সে উঠে দাঁড়ালো যে পড়ে গেল লণ্ঠন, অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক।
তারপর নুপুরের শব্দ উত্থিত হল আবার।
পড়ে গেল দুধের ঘড়া।


(৩)


একি হলো!
কার বাশির সুর শুনে রাধার প্রাণ উদ্বেলিত হলো?
রাধার মন-যমুনার উর্মিতে কার বাঁশি এমন ঢেউ এর সৃষ্টি করলো।
রাধা উন্মত্তের মতো ছুটতে লাগলো।
প্রথমে গোয়াল ঘরের দরজা, তারপর সদর দরজা, তারপর বাড়ির পথ ছেড়ে রাস্তায় পৌঁছালো।
উন্মত্তের মতো ছুটতে লাগল রাস্তা দিয়ে।
ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে গেল।
তারপর রাস্তা থেকে সরে গিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল যমুনার দিকে।
ধীরে ধীরে ঘাস সরে গিয়ে কাঁটা ফুটে উঠতে লাগলো, তারপর ধীরে ধীরে ঘাস পেরিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ পথ দিয়ে ছুটতে লাগলো।
তার কোন হুঁশ নেই।
তার কোন খেয়াল নেই।
সে কোথা দিয়ে চলেছে।
কাঁটা বিস্তৃত পথের উপর দিয়ে চলেছে তার কোন হুঁশ নেই।
সে যেন বিভোর হয়ে আছে ওই বাঁশির সুরে।
রাধার কোমল পা দু'খানি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগল কাটায়।
রক্তরাঙা হয়ে উঠল দুই পা।
তবু রাধার হুঁশ নেই, খেয়াল নেই, সে ছুটে চলতে থাকলো উন্মত্তের মতো, উন্মত্ত হরিণীর মতন।


(৪)


তারপর দেখতে পেলো - উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে বসে আছে এক নীল-বালক।
সারা আকাশ উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছে।
নীল-বালক এর দেহ থেকে যেন অবিস্মরণীয় জ্যোতি বেরোচ্ছে।
যমুনার তীরে এক বিশাল কদম গাছ।
তার নিচে উপল বিকীর্ণ সবুজ মাঠ।
মখমলের মতো সবুজ ঘাস চারিদিকে বিস্তৃত।
গাছের নিচে একটি পাথরে বসে আছে সেই নীল-বালক।
হাতে তার সোনা নির্মিত একটি বাঁশি।
এই মোহিনী সুর নির্গত হচ্ছে ওই বাঁশি থেকেই।
যমুনার জল উথাল-পাথাল করছে সেই বাঁশির শব্দে।
কদম ফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে।
সেইসঙ্গে দুলছে রাধার মন-যমুনা।
রাধা আরো কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
কৃষ্ণের পাশে একটি দুগ্ধশুভ্র গাভী বসে।
কৃষ্ণের পায়ের নিচে ফুলের শোভা।
স্বর্গ থেকে দেবতারা যেন ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিপাশে।
রাধা এসে বসে পড়ল কৃষ্ণের পায়ের কাছে।
কৃষ্ণের কাছে আসতেই তার পায়ের সমস্ত রক্ত মুছে গেল, পায়ে ক্ষতের কোনো চিহ্ন নেই!
দুই হাত জোড়া করে বুকের কাছে এনে শুনতে লাগল সেই অবিস্মরণীয় সুর।
কৃষ্ণের অধরে এক চির প্রশান্তির হাসি।
রাধার মন ভরে উঠলো।
পূর্ণ হলো রাধার মন-যমুনা।