আনাস্তাসিয়া আফানাসিয়েভার কবিতা


(জন্ম ১৯৮২ তে খারকিভে।  তরুণী বয়সেই পেয়েছেন বিশিষ্ট সম্মান ।  রাশিয়ান ভাষাতেও লেখেন।  পেয়েছেন রাশিয়া  থেকেও অনেক সম্মান । নিখাদ গদ্যের মতো করে ডক্যুমেন্টারি স্টাইলে কবিতায় পরিবেশন করেন যুদ্ধের বিভিষীকা , আর্তজনের হাহাকার । ইংরেজি অনুবাদে যুদ্ধের উদ্বাস্তুদের ওপর তাঁর কবিতা আমেরিকায় স্টিফেন স্পেন্ডার নামাঙ্কিত কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। )


        ।।১।।


ঐটা আমার বাড়ি
ওখানে একটা ব্রিজ ছিল
এখন নেই।


ঐটা আমার বাড়ি
ওখানে একটা খোলা জায়গা ছিল
এখনো আছে।


ব্রিজটা যেখানে ছিল
সেখানে একটা নদী ছিল
নদীটা এখনো আছে।


ওখান দিয়ে যাওয়ার একটা পথ ছিল
এখন একটা পথরেখা শুধু বটে।


ওই পথের ধারে
এখন আমাদের বাস।


শয়তানের এক গর্ভ
এখন আমরা সেইখানেতেই থাকি।


             । । ২। ।


আমি ফিরে এসেছি
কোনো রকমে,
কিছুক্ষণ লাগলো
সব ক'টাকে বার করে আনতে
আমদের খুব বড় পরিবার
বুড়ো বাপ মা
ভাই বোন  
আমার গর্ভবতী মেয়ে
ওই সাঙ্ঘাতিক বাড়িটার থেকে
আমি সব্বাইকে বার করে আনলাম।
একবার শুধু ভাবুন
এখানে একটা নদী আছে
তার ওপর একটা ব্রিজ ছিল
ব্রিজটা আর নেই
এপারে আমরা
ওপারে জানিনা ওরা কারা
মধ্যিখানে আমাদের বাড়ি
কতবার ওপারে গেছি, এসেছি
ওপার এপারের মাঝখানে
ছায়ার মতো এই বাড়ি,
যেন বাড়িটার দেওয়াল ফুঁড়ে
ছুটে যাচ্ছে বুলেট
আর বাড়িটা তার কড়ি বরগা
ডান দিক  বাঁ  দিক বেঁকিয়ে
কোনো রকমে কাটিয়ে যাচ্ছে পাশ।
আমি একা একটা মেয়ে
একে একে এদের
এই শয়তানের গর্ভ থেকে
টেনে বের করতে কেমন লাগে
আপনারা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না।
একবার করে ঐ শয়তানের পেটের মধ্যে
ঢোকা আর এক জন করে বাইরে আনা
প্রত্যেক প্রবেশের পর মনে হয়
বেরোবার আর কোনো পথ নেই।
কিন্তু আমি পেরেছি
সব ক‘টাকে বের করে এনেছি।
এখন আমার গর্ভবতী কন্য বলছে,
সে ফিরে যাবে কাল
ওখানে তার ভালোবাসার  মানুষটা রয়ে গেছে।
আর ভালোবাসা ?
আপনারা জানেন ভালোবাসা
কোন রাস্তা  ধরে হাঁটে
এই সব যুবক যুবতীর দল
ভালোবাসা , শুধু ভালোবাসার  জন্য
যে কোনো কিছু


ভাসাইল  হলোবোরদকোর কবিতা


( জন্ম ১৯৪৫ সাল। রাশিয়ার  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অসহোযোগিতার কারণে বিতাড়িত। কুড়ি বছরের জন্য রাশিয়ায় তাঁর সব লেখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাঁর কর্মক্ষেত্রে যোগদানে নানারকম বাধার সৃষ্টি করা হয়। কবি কখনো খনির মজুর,কখনো কৃষকের কাজ করে কায়ক্লেনশে দিন গুজরান করেন। পেরেস্ত্রৈকার পর তাঁর কবিতার বই একে একে প্রকাশিত  হতে থাকে ও বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়।
ইউক্রেনের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান শেভচেনকো পুরস্কার পেয়েছেন।


মানুষ যেমন ইচ্ছে করলেই শৈশবের দিন গুলোতে ফিরে যেতে পারে না, কিন্তু শত প্রতিবন্ধকতাতেও শৈশবের দিনগুলো থেকেই যায়, তেমনি যুদ্ধে বিধ্বস্ত নিজের দেশ গ্রামও ধ্বংস হয়েও থেকে যায়।  আর পাশাপাশি থাকে বেদনা , হতাশা ,উৎকণ্ঠা ।  এই ভাবনা
নানারকম ডিটেলের মধ্যে দিয়ে কবির কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। )


ঝুঁকে পড়ে মাটি থেকে একে একে
কুড়োতে থাকে আমার পদচিহ্ন সব
আমি ছত্রাক তুলি
তুলি ভেষজ কোনো চারা
ফুল তুলি
কিন্তু না,
আমি তুলে জড়ো করি
আমার পায়ের ছাপ গুলো,
যেখানে যেখানে আমার ছোঁয়া লেগেছে,
যেখান দিয়ে হেঁটে গেছি বহুবার :
এই তো এইখান দিয়ে চরাতে নিয়ে যেতাম
এক পাল ভেড়া,
এই তো এখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে
পৌঁছে যেতাম ইস্কুলে আমার,
এই তো এইখানে কাজে যাবার সময়কার
আমার পায়ের ছাপ।
কেউ এসব নষ্ট করার আগেই
আগে ভাগে সব ছাপ তুলে নিয়ে
ঝুলিতে পুরে ফেলি আমি।


বইয়ের পাতার ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে
গুঁজে রেখেছি পায়ের ছাপ গুলো আমার।
এখন যখন কোনো বই পড়ি
হঠাৎ করে খুঁজে পেয়ে যাই
পুরোনো কোনো পায়ের চিহ্ন আমার।
খুব ভালো করে দেখি—
এই তো সেই চেরিগাছটার নিচের
পায়ের ছাপটা আমার।


জমিয়েছি আজ অবধি
পায়ের ছাপ যত
সেসব বইয়ের মাঝে
সুবিশাল হারবেরিয়াম এক ।
শুধু পরপর বসিয়ে দিলেই হবে
তারা সব পৌঁছে দেবে বাড়িতে আমায়।


বরিস হিউমেন্যুকের কবিতা


(জন্ম ১৯৬৫। পেশায় লেখক, সাংবাদিক , কবি। ২০১৩ সালে ইউক্রেনের রেভ্যুলিশন অফ ডিগনিটিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ।  তারপর থেকে সন্ত্রাস বিরোধী একটি স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা গঠিত মিলিটারি বাহিনীর সেচ্ছাসেবী সৈনিক ।
তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক কবি সাংবাদিক । তাঁর কবিতাতে তাই সরাসরি যুদ্ধের গোলাগুলির  শব্দ,গন্ধ,বিভীষিকার স্বাদ পাওয়া যায়। )


আজ আবার আমরা মাটি খুঁড়ছি।  
এই ভয়ে স্থির হয়ে যাওয়া
ঘিনঘিনে  মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে  গিয়ে
তার মধ্যে ঠাসাঠাসি  করে লুকিয়ে আছি।
এখনো বেঁচে আছি।


মায়ের পিছনে শিশুর মতো
আমরা এর পিছনে নিঃশব্দে
লুকিয়ে আছি।
আমরা এর হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।
ভীত সন্ত্রস্ত নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনছি ।
আমরা এর ওম নিচ্ছি
আমরা এখনো বেঁচে আছি।


আগামী কাল
হয়তো সকলে
কিম্বা অনেকেই মারা যাব।


এ মাটির বুক থেকে
এ মায়ের বুক চিরে
আমাদের তুলো না।
মাঠের এখানে ওখানে
ছিন্নভিন্ন পড়ে থাকা
আমাদের টুকরো গুলো
জড়ো করে আমাদের
শরীর বানিও না দোহাই ‌
মিনতি করি
এইখানে ক্রস পুঁতে রেখো না,
রেখো না কোনো ফলক
লিখো না তার ওপর আমাদের নাম।
এসব স্মৃতির ফলক
আমাদের নয়,
তোমরা নির্মাণ করো
তোমাদেরই কাজে
শুধুে মনে রেখো
এই ধরিত্রীর বুকে
এই মাঠে শুয়ে আছে
কিছু ইউক্রেনিয় সেনা।


এই শরীর আমাদের বাবা মা'র কাছে
হাজির করো না কখনো
তারা দেখতে চায় না এমন শরীর।
ছোট বেলার মহাদুষ্টু ছেলেটা
পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছে
হাঁটু ছড়ে গেছে , গায়ে কালশিটে
প্রতিবেশীর বাগানের আপেল চোর
দোমড়ানো মোচড়ানো
গাছের আঠা লাগা শার্ট
পরীক্ষায় গাড্ডু মারা
লাল দাগ ভর্তি মার্কশিট
এসব নিয়েই থেকে যাক তাঁরা
বরং তাদের ভাবতে দাও
কোথাও একটা আছি আমরা
এক দিন আসব ফিরে ঠিক।


হাজির করো না এ শরীর
আমাদের বৌদের কাছে
তারা ছুঁতে চায় না
এই বরফ শীতল কপাল আর ঠোট ।
সেই সুদর্শন জোয়ান
সেই উষ্ণ আলিঙ্গ
সেই দীর্ঘ চুম্বন
সেই প্রেমিক স্বামী
এই সব নিয়ে থেকে যাক তারা।


ফিরিয়ে দিও না এ শরীর
আমাদের সন্তানদের কাছে।
তাদের মুঠোয় ধরা আমাদের হাত
আমাদের স্নেহ ভরা চোখ
এই সব নিয়ে থেকে যাক তারা।


বরং এখানে ফলুক সোনালী গম
তার ওপর বিস্তীর্ণ আকাশ
সেখানে উড়ে যাক হাঁস


সে‌ই বেশ ভালো হবে
তোমরা সেই গমের আটার রুটি
খেতে খেতে ভাববে আমাদের কথা
এই খানে এই মাঠে শুয়ে আছি আমরা।


সেই বেশ ভালো হবে
এই মাঠ ভরে যাক ফুলে
সেখান থেকে ফুল তুলে নিয়ে যাক
প্রেমিকের দল


শিশুরা খেলা করবে মাঠে।


কিন্তু এসব তো কালকের কথা
এখন তো আমরা খুঁড়ছি
আমাদের প্রিয় এই মাটি
সৈনিকের কোদাল দিয়ে
এ মাটির বুকে
লিখে যাই
শেষ জীবিত ইউক্রেনিয় কবির
শেষ কবিতা।


(সংক্ষেপিত)


কাতেরিনা কালিতকোর কবিতা


( জন্ম ১৯৮২। কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক। ইউক্রেনের এই তরুণী এই অল্প বয়সেই পেয়েছেন বহু পুরস্কার। অনেক গুলো ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর কবিতা।তাঁর রচনায় আছে টুকরো টুকরো সুন্দর জিনিষ দিয়ে যুদ্ধের বিভৎসতাকে তুলে ধরা।যেন ধংস থেকে নির্মানের এক উল্টো রাস্তা প্রদর্শন )


মা, আমাকে একটা ছবিও পাঠাওনি তুমি
ভুলেই গেছি কেমন দেখতে তোমায়।
জানি, অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়
তুমি কাঁদবে
কিন্তু এক একটা দুঃখ
এক এক ফোঁটা রক্তের মতো
আমার ঐ সবচেয়ে সুন্দর জামাটার
গায়ে লেগে আছে।


জীবনটা রাস্তার  ধারে
আমাদের গ্রামের পুরোনো বাড়িটার মতো দোমহলা,
সামনের দিকটাতে মৃতদেহগুলো
সাফসুতরো করা হচ্ছে,
তাদের ঘিরে কাঁদছে কিছু মানুষ
অন্যমহলে চলছে কনে সাজানোর কাজ।


মা, আমি চাই তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখো
আমাদের বাড়ির যেখানে
অনেকটা আলো এসে পড়ে
সেখানে আমি বসে আছি।


উফ তুমি এতো কাঁদো না মা,
আমি তোমার মুখটাই ভালো করে দেখতে পাই না
যাকগে মুখ দেখাটা ব্যাপার নয়,
তোমার চুল—সেই চুলের মধ্যে
মাঠের ভুট্টা ক্ষেতের গন্ধ
আমার খুব মনে পড়ে


ওরা সবাই আমাদের থেকে কিছু চায়
তাই নাড়া দিয়েই চলে, দিয়েই চলে,
পিঁপড়ের মতো সেনা বাহিনীর বানানো
উই ঢিপির ওপর একটা মরা পচা মাছের মতো
পড়ে আছে এই দেশ।
আমি এ্যন্ড্রিউকে সব মনের কথা লিখে
একটা লম্বা চিঠি লিখলাম।
উত্তরই পেলাম না।
কে জানে বোধহয় ঠিকানাটা ভূল ছিল।


তবে তার আগেই এ্যন্ড্রু আমাকে চিঠি লিখেছিল,
লিখেছিল—শহর থেকে ওর বাবা
যেসব চকলেট এনে দিত
তার স্বাদ এখনো ওর মুখে লেগে আছে।
আমাদের বাড়ির পিছনে সেই
পিচ্ছিল খাদানটার কথাও ওর মনে আছে।
আর পিটার,
ওও লিখেছিল,
জানিস,এখান থেকে স্ট্রেচারে না চেপে
বেরোনো যাবে না।
মা,ঠিকই বলেছিলে
আমাদেরও জেলে হওয়াই উচিত ছিল।


ঝম ঝম করে ড্রাম বাজিয়ে বৃষ্টি পড়ছে
ফ্রন্ট লাইন কাদায় কাদা,
মেঘে ভর্তি আকাশের নিচে দিয়ে
নদীর ধার দিয়ে
আমরা  বিপর্যস্ত
কুচকাওয়াজ করতে করতে চলেছি,
মনে হচ্ছে মাথাটা ফুটো হয়ে গেছে,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছে
আমার সমস্ত স্মৃতির সঞ্চয়।
সব কিছু ভুলে যাচ্ছি মা !
আচ্ছা হাফিয়া বলে ওই মেয়েটি
এখনও চার্চে আসে?
কয়্যারে গান গায় ?