কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন সবাইকে ছেড়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো শাকের ও সায়মা। শাকের নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলো। তার আগে খুন করেছিলো তার অনেকদিনের প্রেমিকা সায়মাকে। অসহ্যকর এক তিক্ত সম্পর্ক দুটি তাজা প্রাণের অকাল প্রয়াণ ডেকে এনেছিলো। সায়মাকে খুন করার পর আত্মহত্যা করার আগে শাকের তার নিজের শরীরের বিভিন্ন স্থান কেটে রক্তাক্ত করেছিলো। রক্ত দিয়ে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলো সে। খুব প্রিয়, খুব আপন একজন মানুষের উপর ওর যতো অভিমান, যতো রাগ, যতো অভিযোগ ছিলো তার সবগুলোই যেনো প্রলাপসম অল্প কিছু শব্দের মধ্য দিয়ে সেই চিঠিতে লিখে গিয়েছিলো।  

এই দেখো, শেষ করে ফেললাম নিজেকে,
ঠিকই শেষ করে ফেললাম আমার জীবনকে,
আশাগুলোকে, স্বপ্নগুলোকে আত্মাহুতি দিতে হলো,
যে কষ্টে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করেছো আমাকে
তাতে মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আর,
যে বিষে তিক্ত করেছো সে বিষে যন্ত্রণায় করি ছটফট,  
অবিরাম যন্ত্রণায় কী যাতনাই না ধরিয়েছো এই বুকে,
তোমার যন্ত্রণা শূল বিদ্ধ করছে আমাকে প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত  
বুকের ভিতরে ঝরাচ্ছে রক্ত অবিরাম, অবিরত,
আমার ভিতরটাকে করেছো চৌচির, বিদীর্ণ, ক্ষত-বিক্ষত,
সেই রক্তের প্রতিটি ফোঁটায় আজ লিখে যাচ্ছি দেখো
কেনো আমাকে আত্মহত্যা করতে হলো, কেনো ছাড়তে হলো পৃথিবী,  
জানি, আত্মহত্যা মহাপাপ, আমাকে তবে মহাপাপই করতে হলো!
আত্মহত্যা করাটা জরুরিই ছিল, খুব জরুরি ছিলো, খুব,
অসহ্য যন্ত্রণা যে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছিলো!
আমার দেহের প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ ধ্বংস হচ্ছিলো,
ভেবেছিলাম দিতে এসেছিলে দিশা, আশায় ভরেছিলো বুক,  
বুঝতেও পারিনি, সদাহাস্য মুখের আড়ালে ছিলো সর্পিণীর মুখ,
আর্সেনিকের কণার মতো ঢুকেছিলে আমার ভিতর,
কি ধীরগতিতে গ্রাস করে ফেলেছিলে আমাকে!  
ভিতরটা পুড়িয়ে দিয়ে বাহিরটা রেখেছিলে ঠিক,
আমি বুঝতেও পারিনি আমি যাচ্ছিলাম কোন দিক!
কী এক নিবিড় পরিকল্পনা ছিলো আমাকে কষ্ট দেবে বলে!  
এতটুকু তাড়াহুড়া ছিল না কোথাও!
তাড়াহুড়ো করলে হয়তো আমি কষ্ট কম পেতে পারি?
এতো নিষ্ঠুর ছলনা! এতো নিষ্ঠুর পরিকল্পনা!
আমাকে বুঝতেই দাও নি! বুঝতেই দাওনি কিছু!
কী এক পরিকল্পনাকারী ছিলে তুমি! কী অনাচারী!
আমার হৃদয়ে চালিয়ে দিলে ছলনার তরবারী!
যখন বুঝতে পেরেছি তখন সব পুড়ে শেষ, উড়ন্ত ছাই,
আজ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার অধিকারই নাই,  
কি প্রেম দিয়েছিলে তুমি! কি কলরব!
তোমার মুখের মুখোশে আমি হারিয়েছি সব,
জ্ঞানের রাজ্য যেনো অসাড় হতো দেখলে ও মুখ,  
বেকুবের মতো মুহূর্তেই ভুলে গেছি সব, চেপে ধরে বুক,
আর বুঝলেই বা কী করতাম আমি?
কি অথর্বই না বানিয়েছো আমাকে!
তোমার পরিকল্পনা যতোটা বুঝেছি, তা নেহায়েত কিছু ছিলো না,
তবে বুঝেছিলাম আমাকে শেষ করে ফেলছো তুমি,
বলতে পারিনি কিছু, চুপ করে থেকেছি,
হাসির আড়ালে তোমার মুখোশও দেখেছি,
একটু ভালোবাসা পাবো সে আশায় সয়েছি,
যেভাবেই রেখেছো সেভাবেই রয়েছি,
আবার ভেবেছি, কিছু একটা করতে হতো আমাকে।
সেই কিছুটা সম্পর্কে অনেক ভেবেছি আমি।
ভাবতে পর্যন্ত ভয় হচ্ছিলো, খুব, খুব ভয় হচ্ছিলো।  
না জানি কি ভুল করে বসি! কি মহাভুল!
কখনও কেঁদেছি। কখনও ছিঁড়েছি মাথার চুল।
আজ এই ক্ষণে বসে কিছু করতে যাচ্ছি,
সেও তোমাকে শাস্তি দিতে নয়,
ভুলের মাশুল দিবো আর এক ভুলে!
আজ নিজের বুকে নিজেই ছুড়ি দিলাম তুলে।  
আমার এখন মনে হয়না কোন ভুল করছি আত্মহত্যা করে।
তুমি কি বলো? ভুল করছি?  
খুবই আপেক্ষিক একটা প্রশ্ন করছি, দেখো।  
তোমার কাছে যা ভুল মনে হবে।
আমার কাছে তা হয়তো একদম সঠিক।
শুধু বলি, আমাকে কেনো আজ চলে যেতে হচ্ছে?
কেনো আমাকে পুড়িয়ে করে দিলে ছাই?
কেনো যাকে সব ভেবেছিলাম সেই আজ কাছে নাই?
তুমি আমার কষ্টের কথা জানতে না?
জানতে না আমার এই অসহনীয় কষ্টের উৎস কী ছিলো?  
জানতে, তুমি সবই জানতে।
সব জেনেও কেন এতো নিষ্ক্রিয় ছিলে?
শুধু যন্ত্রণা দিতেই এসেছিলে এই পৃথিবীতে?
তুমি কি কিছুই করতে পারতে না?
পারতে না আমাকে বাঁচাতে?
পারতে না নিজেও বাঁচতে এই আমার সাথে?
আচ্ছা যাও আর প্রশ্ন করবো না,
বিব্রত করবো না তোমাকে।  
বিরক্ত হয়ো না, শেষ বেলা তোমাকে বিরক্ত করবো না আমি।
আর এ বেলা এসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না।
কিন্তু সব কিছুরই কি মানে থাকতে হয়!
থাক, থাক, বাদ দাও এসব কথা।  
জানো, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম
সেদিন আমার তেমন কোন বিশেষ অনুভূতি হয় নি।
নাহ! একদমই হয়নি, কোনো আবেগ আসেনি মনে।
আমার হৃদকম্পন বাড়েনি, ঘামেনি কপাল, ছানাবড়া হয়নি দুচোখ,
শুধু ভেবেছিলাম, কিছু যদি হয়, তবে তাই হোক।  
মনে হয়নি কিছু পরিবর্তন হয়েছে আমার, তখন পারোনি রাখতে কোনো ছাপ,
শেষে বুঝলাম, অনেক কিছু করেছো তুমি, আর আমি করলাম মহাপাপ!  
কোন ক্ষণেই হয়েছিলো দেখা,
খুব স্বাভাবিক চাহুনি, খুব স্বাভাবিক কিছু কথা?  
তখন সেটা একেবারেই স্বাভাবিক ছিলো।  
হয়তো আপাতদৃষ্টিতে তাই ছিলো।
আসলে সেটা একদম স্বাভাবিক ছিল না।
কিছু একটা অন্যরকম ছিল, খুব আলাদা।  
তা না হলে এতপ তাড়াতাড়ি অবস্থার এতো পরিবর্তন হলো কেনো?  
সত্যি! একদম সত্যি বলছি!
আমি সামান্যও বুঝতে পারিনি কিভাবে হলো এতো পরিবর্তন,
কিভাবে জড়ালে আমাকে, কেড়ে নিলে মন।  
কিভাবে আমার হৃদয়ে স্থান করে নিলে!
ভুল বললাম, স্থান করে নিলে না,
আমার অস্তিত্ব হরণ করলে আর আমাকে বাধ্য করলে
তোমার অস্তিত্বের উপর বেঁচে থাকতে।
আমার তা করতে এতোটুকু খারাপ লাগতো না।
কি যে ভাল লাগতো তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না!
একটা সময় সমস্যার সৃষ্টি হলো, সে আরেক জায়গায়।
তোমার অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে বাঁচতে আমাকে দিলে না।
এখন বলো, মৃত্যু ছাড়া আমার আর পথ কই?  
যখন সব শেষ করে দিয়ে বলো, ‘আমি তোমার নই’।
সর্বত্র দেখি তোমার আঘাত আজ লাগামছাড়া,
খুঁজে দিতে পারতে কোন পথ এই মৃত্যু ছাড়া?  
না, তুমি পারতে না। কেউই পারত না। পারতো না কেউ।
আমি পড়েছি অনিশ্চয়তার মুখে, আমাকে টানছে মরণের ঢেউ।
আর কোনো পথ নেই কুল খুজে পাবো,
তাই করেছি ঠিক, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।
তাই এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি।
অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খুব ভেবে চিন্তে,  
আমার মস্তিষ্কে যে ঝড় বইছিলো তার মধ্যে
যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি তাই বা কম কি!
এ যে রীতিমতো গর্ব করার বিষয়! তাই নাহ!
আমি গর্ব করছি না, শোনো, আত্মহত্যায় গড়ব নেই কোনো।
গর্ব করার মতো অবস্থা যে আমার একদমই নেই।
আমাকে আবার পাগল ভাববে নাতো!
কষ্ট পেলে কেনো জানি আমার খুব হাসি পায়।
ওই হাসিটা যে কি কষ্ট দেয়। খুব বড় এক কষ্ট।
দেখো! দেখো! এখন আমি কেমন মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসছি।
এই হাসির মধ্যে কিন্তু আনন্দও আছে। অবারিত সে আনন্দ।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আনন্দ। যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আনন্দ!  
এ এক ভয়ানক আনন্দ!
একেই সাথে আমাকে তীব্র কষ্ট দিচ্ছে।
সমস্যা নেই। এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো।  
আমাকে সহ্য করতে হবে।
এই কষ্ট সহ্য করলেই তো ওই আনন্দটা পেতে পারবো।  
আমার অতি আকাঙ্ক্ষিত আনন্দ।
আমি তো চাইনা এই নিকৃষ্ট কষ্ট গোগ্রাসে গিলে খাক আমার এই আনন্দকে।
আমি এটা হতে দিতে পারিনা।
কখনই হতে দিতে পারবো না।
দেখো তো কেমন পাগলের মতো হাসছি এখন!  
ওই যে ওখানে যে বিড়ালটা দাঁড়িয়ে আছে,
ও কি আমাকে দেখছে? হয়তো দেখছে।
কি শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে!
ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে।  
দেখো, আমি কি রকম ঘামছি।
এই! দেখো না। বিড়ালটা একদৃষ্টিতে আমার হাতের ছুরিটার দিকে।
লাল রক্ত দেখছে। তাজা লাল রক্ত।
তোমার নিসাড় নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।
আমি তোমার কাছে আমার অস্তিত্ব হারিয়েছিলাম।
বাঁচতে চেয়েছিলাম তোমার অস্তিত্তের উপর।
তা যখন পারলাম না, আমি সেই অস্তিত্ব বিনাশ করলাম।
এটাকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কি বলব ?
আমার এখন যে রক্তমাংসের শরীরটা আছে তা ঠিক আগের মতই।
কিন্তু এ আগের আমি নই।
আমার আগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
এ এক নতুন আমি।
এই নতুন ‘আমি’কে রেখে কী করবো আমি?
তোমাকে নিয়েই তো ছিলো যতো পাগলামি।
এই দেখো আমি চিঁরে ফেলছি আমার এই বুক,
আজ তুমি পাশে আছো, নিশ্চুপ, তবুও কতো সুখ!
আমার হাত পা কাঁপছে কেনো এই লাল রক্ত দেখে।
দেখো, তোমার রক্ত আমার বুকে মেখেছি, আমার রক্ত দিচ্ছি তোমাকে মেখে,  
এই লাল রঙ তো ভালবাসার লাল রঙ।
দেখো, রোদ পরে কি সুন্দর চিকচিক করছে !
জীবন পারেনি যা, তা করেছে দুজনের এই রক্তের ঘ্রাণ,
পৃথিবী থেকে সরিয়েছে দূরে, কিন্তু এক সুতোয় বেঁধেছে দু’প্রাণ।