আবার এসেছো হে ছলবিলাসিনী,
মরীচিকারূপী একদল মায়াবিনী!
মেঘাচ্ছন্ন কুয়াশা সরিয়ে আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি,
বেশ দেখতে পাচ্ছি ফেলে আসা সুদূর অতীত।
অতীতেও এসেছিলে সব দলেবলে,
তোমাদের আপাত-উত্তাপে আমাকে উত্তপ্ত করতে,
মায়াবরণে আবৃত করতে আমার অন্তরকে এসেছিলে আগেও।
আজ আবার এসেছো হে মোহপ্রসারী মায়াবিনীরা!
এবার কি তোমাদের বেঁধে দেবো তোমাদের এই প্রকটিত রূপে?
এলে যদি, আরো কাছে এসো।
গ্রহণ করো আমার জীবন-যৌবনের সার্বভৌম কর্তৃত্বভার।
তোমাদের আবির্ভাবে আলিঙ্গণ করে সর্বগ্রাসী যাদু।
আমি উন্মাদসম ভ্রমর সাজি, এনেছো কি মধু!
ক্ষণ-উন্মাদনায় ছায়ান্ধকার আচ্ছন্ন করে আমায়,
আচ্ছন্ন করে রহস্যের কুয়াশা।
আচ্ছন্ন করে আমার ইন্দ্রিয়চেতনা।
যে অশান্ত যৌবনাবেগের মেঘভারে মৃদু বিকম্পিত,
শিহরিত হয়ে উঠে আমার সমগ্র অন্তরাত্মা,
সে কুয়াশা, সে মেঘ থেকে মুক্ত করো আমায়।
এ পার্থিব বিশাল বস্তুপুঞ্জমন্ডিত বর্তমান আঁকড়ে ধরেছে আমায়,
এক প্রায়ান্ধকার অস্বচ্ছ চেতনার রাজ্য ঘিরে রেখেছে চারিদিকে,
এ রাজ্য থেকে আমাকে নিয়ে চলো আরও এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে।


তোমরা এসেছো, ফিরেছে অতীত, আবার ফিরেছে সুখস্মৃতি,
অতীত দিনের অনেক সুখস্মৃতি ভীর করেছে আমার মনে।
প্রেম ও বন্ধুত্বের স্মৃতি, পাওয়া-না পাওয়ায় স্মৃতি
সুকরুণ বেদনার এক একটি মূর্তি ধরে গোলকধাঁধাসদৃশ
আমার জীবনের কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে আবার, নতুন করে, প্রতিক্ষণে।
কেলিকপটিনী ভাগ্যদেবী অতীত জীবনের সুখস্রোত হতে আমায় বিচ্ছিন্ন করেছে,
অকস্মাৎ, নিষ্ঠুর সে বিচ্ছিন্নতা আমাকে আঘাত করেছে অনবরত,
স্মৃতিসিক্ত এক অবিচ্ছিন্ন মানসপ্রক্রিয়া,
এক দুঃসহ বেদনার জাল বুনে চলেছে আজও।
সুদূর অতীতে যাদের গান শোনাতাম, কন্ঠের নির্যাস বিলিয়ে দিতাম,
তারা আজ আমার গান শোনে না।
তারা চলে গেছে সবান্ধবে চলে গেছে, চলে গেছে দূরে,
তার সঙ্গে সঙ্গে শূণ্যে বিলীন হয়ে গেছে সে গানের সব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
হয়তো তারা আজও বেঁচে আছে, কিন্তু আমার কাছে আর আসে না।
তারা সব পৃথিবীর জনারণ্যে ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে।
আজ যারা আমার গান শোনে, শুনে আনন্দ পায়,
তাদের আনন্দ আমাকে বেদনা দেয়, অসহ্য যন্ত্রণায় ভোগায়।
সে বেদনা, সে যন্ত্রণা বাড়তে থাকে, ছড়ায় আমার শাখা-প্রশাখায়,
আমি শান্তি চাই, এক নিরেট প্রশান্তি এসে ঘিরে ধরুক আমায়,
অসহ্য সব যন্ত্রণা আমাকে যতো কাতর করে ফেলে
বহু আকাঙ্ক্ষিত এক আত্মিক প্রশান্তির জন্য ততই প্রবল হয়ে ওঠে আমার ব্যাকুলতা।
তবু আমি গান গেয়ে যাই, গানের হৃদয়ে আমাকে হারাই।
আকাশচুম্বী উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে চায় আমার গান।
বাতাসের প্রতিটি কম্পনে ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে আমার গানের বীণা।
কম্পিত হয়ে ওঠে আমার সারা দেহ।
একের পর এক করে উত্তপ্ত অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে আমার চোখ থেকে।
অশান্ত অধীর হয়ে ওঠে আমার হৃদয়।


আমি যা পেয়েছি তারা আমাকে ফাঁকি দিয়ে দূরে সড়ে যায়,
আর যা কিছু হারিয়েছি তাদের অশরীরী স্মৃতিরা আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়,
মূর্ত হয়ে উঠে বিব্রত করে তুলছে আমায়, সুরের মুর্ছনা হয়ে আমার হৃদয়কে মাড়ায়।