ধানের মাড়া, ২ টাকায় সিঙ্গাড়া, সাথে কাঁচা মরিচের দানা,
গুড়ের সাথে নারিকেল মিশিয়ে, মাটির হাড়িতে পিঠা রান্না।
মাটির চুল্লি, মশলা মিশানো আচার,
মায়ের হাতে সিদ্ধ আলু, জিভে আসে জলাধার।
পথে হেঁটে যখন চলি, কানে বাজে শালিকের ডাক,
মা বলে, 'বাড়ি ফিরে আয়, ছুটাছুটি আজ থাক।
ধানের ক্ষেত, পুকুর পাড়, সাঁতার কাটে হাঁস,
গাছের ছায়ায় বসে মায়ের হাতে তৈরি পিঠের স্বাদ।
পথে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পাই, পুরনো বাঁশের সাঁকো,
দুষ্টুমি দেখে দেয় দৌড়ানি গ্রামের খলিল কাকু।
ঘরের পাশে গাঁয়ের মাটির সড়ক, খেলার সঙ্গী ভাই,
এক সঙ্গে ছুটে চলি আমরা, হাসিতে গানে গান মিলায়।
বাঁশঝাড় মাঝে পাখি গান গায়,
মাটির মিষ্টি গন্ধে মন উড়ায়।
খেলতে খেলতে মাটি তুলে আনি,
মনে পরে মায়ের হাতে পেঁয়াজু, রুটি, ডাল বাঁধা খানি।
লাল কাঁঠাল পাতা টোকানো, আলু তুলে আনা,
কয়লা কুড়াতে এবাড়ি ওবাড়ী আনা গোনা।
গ্রামের ছবি, শৈশব ভরা, হৃদয়ে করে নাচ,
স্মৃতির পাতায় বোনা থাকে সব ভালোলাগার আঁচ।
স্মৃতির পাতায় লেখা থাকে, আজও তাই মন চায়,
একটিবার ফিরে যেতে—সেই চিরচেনা গায় ।
আমপাকা বৈশাখ এলেই, গাছতলায় মেলা,
পুতুল নাচে, বাউল গানে, শুরু হয় কাবাডি খেলা।
নদীর ধারে হাট বসে যায়, খেজুর রসের পিঠা,
মায়ের হাতে চুলে তেল, গন্ধে মেশে মিঠা।
আষাঢ়ে বৃষ্টি নামে, মাঠ ভরে যায় জলে,
ছাতা ছাড়া দৌড় দিই, নরম ঘাসের কোলে।
চঞ্চল নদী ডাকে ডাকে, টিনের চালায় টাপুর টুপুর,
ভেজা দুপুরে পাখা নেই,তবু শীতলতা দিয়ে যায় সুর।
শরতে আকাশ নীল হয়ে যায়, কাশফুলে ভরে মাঠ,
কতো রাত কেটেছে মাঠে, আলো দিয়েছে চাঁদ!
নবান্ন এলে চালের গন্ধে মুখে ভরে উঠতো হাসি,
সেই আনন্দে কতো যে বাজিয়েছি তাল পাতার বাসি।
কাকডাকা ভোরে উঠে, হাঁস-মুরগি ছাড়া,
সারাদিন থাকতো সময় হাতে ছিলোনা এতো তাড়া।
ঝাঁপি ভরে সবজি নিয়ে ফিরতাম বিকেল বেলায়,
সন্ধা কেটেছে বৌছি আর ডাঙ্গুলি খেলায়।
বসন্ত আসে কুড়িয়ে দিতে পলাশের টুকরো রঙ,
আকাশজুড়ে উড়ছে যেন শৈশবের স্মৃতির ঢঙ।
মাঠের মধ্যে দৌড় ঝাঁপে, সুরে বাজে বাঁশি,
মনের মাঝে গাঁয়ের ছবি কবিতায় তুলতে আশি।
তারপর এলো বেলা পড়া দিন, বইয়ের ব্যাগ ভারী,
খেলার মাঠে সময় কমে, জাগে পড়ার হাড়ি।
তবুও দুপুরে লুকিয়ে রেখে, গাছের ডালে চড়া,
দুষ্টুমিতে মায়ের হাতে কতো খেয়েছি ধরা।
বাঁশের মাচায় বসে পড়ি কবিতা, রোদ পিঠে এসে পড়ে,
শুকনো পাতার মরমর শুরে পাতার বৃষ্টি ঝড়ে ।
চিঠির পাতায় একছিলাম মন,
লুকিয়ে লুকিয়ে লিখেছি কতো গান,
তারপর একদিন ট্রেন চলে যায়, আমি শহরের পানে,
পিছনে ফেলে রাখি ফসলভরা মাঠ, মায়ার উপাখ্যানে।
স্টেশন দাঁড়িয়ে ভাবী কতো প্রিয় মুখ,
ফেলে যাচ্ছি তালা দিয়ে বুক ।
নতুন শহর, ব্যস্ত জীবন, কংক্রিটের খাঁচা,
ধোঁয়ার মাঝে মুক্ত বাতাসের অভাবে কোন মতো বাঁচা।
নেই আর সেই পুকুর পাড়, নেই বন্ধুর হাত,
অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর চায় না খেতে ভাত।
যদি হঠাৎ কোনো রাতে, স্বপ্ন হয়ে আসে,
ধানের গন্ধ, কুয়াশা ঢাকা ভোরের নরম পরশে।
শালিক ডাকে, নানী বলে, "বাড়ি আয় রে বাছা,"
ঘুম ভেঙে যায়, জানালায় দেখি—শুধুই কাঁচা রোদাচ্ছা।
আজ গাঁয়ের পথে ধুলো উড়ে, চেনা গন্ধ নেই,
দেখি কিশোর ছেলেগুলো পড়ে আছে মুখে মোবাইল রেখেই।
বাঁশের সাঁকো নেই আর ওখানে—পাকা ব্রিজ দাঁড়িয়ে,
খলিল কাকু চোখে চশমা—নীরবে বসে হাঁপিয়ে।
মাটির চুল্লি নিভে গেছে, পিঠার হাঁড়ি ধুলায়,
পুকুর পাড়ে হাঁসও কম, ছেলে-মেয়েরা ভুলোয়।
ঘরের কোণে পেতেছি মাথা, যেখানে বসতাম চুপে,
আতকে উঠে বুক, কোথায় তা, হারিয়ে ছিলাম যে রূপে।
তবু একধারে রোদ পড়ে আজও ঠিক আগের মতোই,
সেই আলোয় দেখি—ছোট্ট আমি, বদলেছি আজ কতোই ।
আম গাছের তলায় ফের বসে গল্প বলি ছেলেকে,
শোনাই কেমন ছিলাম আমরা, কতো বদলেছি একে একে ।
গ্রামটা পাল্টেছে অনেকটাই, কিন্তু মনটা নয়,
স্মৃতি মিশে আছে ঘাসের ফাঁকে, হৃদয় করে জয় ।
আজ আমি শহর থেকে বলছি,
মনটাকে নিয়ে কিন্তু গাঁয়ের পথেই চলছি।