ক্রমশ দূর থেকে দূরত্বর হয়ে যাচ্ছি আমরা
আমার একমাত্র নয়নয়ের মণি প্রদীপ
আমার আর সুতাপার আদরে লালিত প্রদীপ
আমাদের আশা ভরসা পুত্র প্রদীপ।
আজ ঠিক বিকাল ৩ টের সময়
ও আমাকে নিয়ে এল এখানে
বলল, বাবা আপনি এখানেই ভালো থাকবেন
আমি যোগাযোগ রাখবো আপনার সাথে
আপনার কোন অসুবিধা হবে না
এতেই নাকি ওদের নতুন সংসারের শান্তি।
আমি কিছু বলিনি ওকে
আমার মনের কথা বলবই বা কাকে?
কে শুনবে আমার কথা?
কে বুঝবে আমার যন্ত্রণা!
তাই এই খাতায় লিখে রাখছি
বৃদ্ধাশ্রমে বসে আমার মনের কথা একা।
মনে পড়ছে পুরানো দিনের কথা
আজ থেকে প্রায় ছাপান্ন বছর আগে
তখন আমি মাত্র ছাব্বিশ বছরের যুবক
তুমি একুশে পা রেখেছো সবে
আলাপ হল তারপর প্রেমালাপ আর...
তারপর তোমায় নিয়ে এলাম
আমাদের কালিঘাটের সেঁতসেতে দু'কামরা ঘরে
আমার বাবা আমাদের মেনে নিলেও
মা মানতে পারলেন না অসবর্ণ বিবাহ।
আমিই ছিলাম সংসারের একমাত্র ভরসা
আমার উপার্জনের টাকায় চলত সংসার
বাবা অসুস্থ অথর্ব মানুষ।
তিনটে বছর কত না গঞ্জনা সয়েছো তুমি
আমি কাজ থেকে ফিরলে
রাতে আমার বুকে মুখ রেখে
শুধু চোখের জল ফেলে গেছ
তবু মুখফুটে মনের কষ্টগুলো
প্রকাশ করনি কখনও।
আমাদের কোন সন্তান হল না
সে দোষও তোমাকেই শুনতে হত
পাড়ার কানাঘুষো আর সহ্য হত না আমার
তবুও বাবার জন‍্য সব মুখবুজে থাকতাম
তারপর এলো সেই কালরাত্রি
বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন
সেই চরম মূহুর্তেও মা সবকিছুর জন্য
তোমাকেই দায়ী করলেন,
বাবার কাজ মিটে যাবার পর
মা নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন
ভবাণীপুরে তাঁর ছোট বোনের বাসায়
তুমি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লে
আমার বদলী চাকরির জন্য
চলে এলাম জলপাইগুড়িতে
কেটে গেল একটা বছর এভাবেই
এরই মধ্যে পরিচয় হল রতনবাবুর সাথে
উনি নিয়ে এলেন ওনার কাজের জায়গায়
অনাথ আশ্রম থেকে সুতপার কোলে
তুলে দিলেন আমাদের প্রদীপকে
রতনবাবুকে আমরা বড় দাদার মতই শ্রদ্ধা করতাম
ভাবতে পারিনি সেই রতনদাকেও আজ এখানে দেখবো!
আমাদের খোকাকে নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নিতে গেলাম
আশির্বাদ তার কপালে জোটেনি, বরং
মা আমাকে সেই দিন থেকে ত‍্যাগ করলেন
শত দুঃখেও আমার চোখে জল আসেনি কোনদিন
কিন্তু সেদিন মা মা করে সারাদিন-রাত কেঁদেছি।
আজ থেকে ঊনত্রিশ বছর আগে
দু'বছরের ছোট্টো প্রদীপকে কোলে নিয়ে কি আনন্দ তোমার
সারাদিন তোমার স্নেহে ছোট্ট প্রদীপকেও
খুব খুশি খুশি দেখতাম,
ধীরে ধীরে ও যত বড় হতে লাগল
ওর যত আবদার সব তুমি মেটাতে
আর যত অন‍্যায় আমাকে মেটাতে হত
তুমি ওকে সুন্দর সাজে সাজিয়ে রাখতে
বলতে - আমাদের রাজপুত্র আমাদের প্রদীপ
তোমার স্নেহের আঁচল ছাপিয়ে ও যেন
কখন বড় হয়ে উঠল আমরা টের পাইনি
টের পেলাম তখন, যখন ওর বয়স আঠাস
আমি অবসর গ্রহণ করেছি সবেমাত্র
ধরা পড়ল তোমায় মারণ রোগ
তুমি ওকে কাছে পেতে চাইতে
আমি বলতাম, খোকার সময় কোথায় বল -
তোমাকে একটু সেবা করবে!
কলেজ, টিউশনি, ফুটবল প‍্যাকটিস আর...
সে কারণে আমিই তোমার সেবক
তুমিও বলতে, খোকাকে অনেক বড় হতে হবে
অনেক বড় মাপের মানুষ হতে হবে
সত‍্যি ও অনেক বড় হয়েছে
বড় চাকরিও পেয়েছে নিজে
তবে সময় নেই শুধু তোমাকে সময় দেওয়ার!
যেদিন তুমি আমাকে কাঁদিয়ে চলে গেলে
সেদিন ছিল ওর ফাইনাল ম‍্যাচ
যার উপর ওর চাকরির পদন্নতি
শেষ পর্যন্ত তোমার মুখাগ্নি করেছিল ও।
তারপর কেটে গেছে একটা বছর
ও বিয়ে করেছে ওর নিজের পছন্দের মেয়ে
কিন্তু তাকে ঘরে আনতে চায় না
আমি জিঞ্জাসা করলেই বলে -
যতদিন তুমি এ বাড়ি আছো ও আসবে না
তুমি যে দিন থাকবে না ....
খোকার মুখে এই কথা শুনে মরতে গিয়েছিলাম
পারিনি তোমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভেবে
তুমি বলেছিলে - ও আমাদের প্রদীপ
ওর আলোতে তুমি আলোকিত
ওকে তুমি যেন কোনদিন পর করে দিও না',
কিন্তু আজ সেই আলোকিত প্রদীপ বুঝিয়ে দিল
তার বিপরীতে যে অন্ধকার সে তার নয়
সেই অন্ধকার ঠুনকো প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছায়া
ত্রিশ বছর পর ও বুঝিয়ে দিল
ভালোবাসা শুধু ভালবাসা নয়
ভালোবাসা যন্ত্রণাময়!