আজ অনেক দিন পর
বাবার মুখে হাসি দেখলাম।
তোদের সব কথা বাবা জানতে চাইলেন
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রায় সবটা বললাম
বাবার চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরছিল
আর কেবলই বলছিলেন -
আমার দাদুভাই বৌমা কেমন আছে?
কত বড় হলো রে আমাদের পুচু?
সুন্দরবন থেকে অনেকটা দূরে
একেবার সল্টলেকে তোদের বাড়ি
উপরে নীচে মিলিয়ে বারোটা ঘর,
চারটে বেডরুম, দুটো স্ট্যাডি রুম
একটা ডাইনিং, একটা বসবার, একটা মিটিং রুম
একটি নৃত্য চর্চার, অপরটি কম্পিউটার রুম
একটি সাজগোজ করবার জন্য
এছাড়া বাথরুম, কিচেন,  ব্যালকনি
মেঝেতে মার্বেল পাথরের কারুকার্য
দেওয়ালে আধুনিক ডিজাইনের পেন্টিং
চেয়ার-টেবিল টিভি-ফ্রীজ
আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি।


অনেকক্ষণ ওয়েটিং রুমে অপেক্ষার পর
চলে এলাম তোদের বাড়ি থেকে
পুচু মানে তোর ছেলে সন্তু অনেক বড়ো হয়েছে
আমাকে চিনতে না পারারই কথা
তবে ওয়েলকাম জানিয়ে বসতে দিয়েছিল
হন্তদন্ত হয়ে হাতে কিছু কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল
লাল রঙের একটা চার চাকার গাড়ি নিয়ে
অগত্যা কিছুক্ষণ বসতেই হলো নরম সোফায়
ততক্ষণে দেওয়াল জোড়া কালার মুভি চলছে
সাথে একপ্লেট  নানারকমের সুস্বাদু মিষ্টি
আর ফ্রীজের ঠান্ডা সরবত।
কেয়ারটেকার ঘুরিয়ে দেখালো উপর-নীচ
আমার আসার খবরটা ফোনে দিয়েছিলে ওনাকে
উনি বললেন দাদা খুবই ব্যস্ত মানুষ
কতশত মানুষ নিয়ে ওনার কাজ
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা
আর বৌদিদি ড্যান্সের ক্লাস-পার্টি করে
ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা
সন্তুবাবু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ নিয়ে
বেশীরভাগ সময় কলকাতার বাইরে,
কথা শুনতে শুনতে লক্ষ্য করছিলাম
দেওয়ালে অনেক মডেলের ছবি
নেতা-নেত্রীদের ছবি টাঙানো
কোথাও বাবা-মায়ের ছবি দেখতে পেলাম না!
হঠাৎ পুচুর ছেলেবেলার ছবিটা পেলাম
ওরই স্ট্যাডি রুমে টেবিলের উপর
ওর ন'বছরের জন্মদিনের ছবি
আমি ওকে পায়েস খাইয়ে দিচ্ছি,
কিন্তু সেই ছবিতে আমি আজ নেই
ভাবতেই চোখে জলে এসে পড়লো।
কেয়ারটেকার একটি কার্ড ধরিয়ে বলল
আগামী পরশু সন্তবাবুর এনগেজমেন্ট
আপনাদের নিমন্ত্রণ পত্রটি রাখুন বাবু
পার্কস্ট্রিটের রাজকীয় হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে
আপনারা সবাই আসবেন বাবু - সেলাম।


বুঝলাম ওনার অনেকটা সময় আমি নিয়েছি
তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে এলাম
আসবার সময় সন্তুর ন'বছরের ছবিটা সাথে নিলাম
আর গোপনে রেখে এলাম বাবার দেওয়া আর্শীবাদ,
মায়ের অনেক আশা ছিল নাতবৌ দেখবে
অকালে মারণ রোগে চলে গেলেন মা
তাঁর দেওয়া সোনার বালা জোড়া রেখে গেলাম
সন্তুবাবুর টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে
সাথে বাবার লেখা একটি চিঠি -
"ষোলোটা বছর তোমাদের কোন খবর পাইনা
গত সপ্তাহে তোমাদের খবর পেলাম
পঞ্চায়েত অফিসের পাত্র বাবুর নিকট
তাঁর ফোনে তোমাদের সব কথা জানিয়েছো
আজ এতবছর পর তোমাদের দেখতে বড্ড ইচ্ছা করছে।
তোমরা সবাই ভালো থেকো।
দাদুভাই কেমন আছে?
তোমার মায়ের দেওয়া বালা জোড়া পাঠালাম
চোখে ভালো দেখি না, চলার শক্তিও নেই
তোমার ছোট ভাই এম এ পাশ করেও
চাকরি না পেয়ে টিউশনি করে এখন
আমাদের দিন চলে যাচ্ছে একপ্রকার
আমরা ভালো আছি বড়ো খোকা
বড্ড দেখতে ইচ্ছে হয় তোমাদের... "
চিঠির উল্টো পাতায় আমার লেখা
- একটা অনুরোধ রাখবি দাদা?
তোকে বিদেশে পড়ানোর জন্য
আমাদের ভিটেবাড়ী আজও বন্ধক
সুদে-আসলে এখন কয়েক লাখ
আমাদের সাধ্য নেই ঋণ পরিশোধের
পারলে বাবার মৃত্যুর আগে এসো
একবার অন্তত এসো পিতৃভূমিতে
পিতৃঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে!'