আমার অপেক্ষা শুরু সেই ভ্রুণ বয়স থেকে।
আমি যখন প্রথম আমার অস্তিত্ব অনুভব করলাম
বুঝতে পারলাম আমার হাত নেই, পা নেই; চোখ-মুখ-নাক-কান-মাথা কিচ্ছু নেই!
আমি শুধুই একটি লাল টুকটুকে মাংস পিন্ড!  
অপেক্ষা করতে থাকলাম পূর্নাংগ অবয়ব লাভের।
অবশেষে যা যা থাকলে আমাকে একজন মানুষ বলা যাবে তার সবি হল।
কিন্ত অবাক এবং বিস্ময় নিয়ে অনুভব করলাম
চোখ থাকলেও আমি তা খোলতে বা কিছু দেখতে পাচ্ছিনা,
নাক থাকলেও তা দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারছিনা,
মুখ থাকলেও খাবার খেতে হচ্ছে লম্বা একটি নলের মাধ্যমে
যা কিনা আমার নাভির সাথে যুক্ত।
আমাকে রাখা হয়েছে খুবি ছোট একটি পানি পূর্ণ প্রকোস্টে।
এত ছোট যে আমাকে হাত পা গুটিয়ে থাকতে হয়।
শুধু শ্রবণ ইন্দ্রিয়টা একটু সজাগ,
মাঝে মাঝেই অদ্ভুদ সব শুনতে পাই
কোন কোন শব্দ শুনে চমকে উঠি আবার কখনো মাথা নারি
তবে একজনের কথা বলার এবং হাসির শব্দ আমি খুব কাছ থেকেই শুনতে পাই
শুধুই তখন দেখতে ইচ্ছে হয় তাকে
অপেক্ষা করতে থাকলাম সেই দিনের।
একদিন অপেক্ষা ফুড়াল, ভুমিস্ট হলাম আমি।
প্রথম বারের মত পৃথীবীর বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম
বহু কষ্টে যখন প্রথমবারের মত চোখ খুললাম
ভয়ানক তীব্র আলোয় ঝলসে গেল আমার চোখ
বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল মানিয়ে নিতে।
বিচিত্র সব শব্দ ভেসে আসতে লাগল আমার কানে প্রথমবার।
সাঁ সাঁ, কিচিরমিচির, হা হা, কক কক, কা কা, ঘেউ ঘেউ
উহু হাজারো শব্দ কানের পর্দায় ঝংকার তুলতে লাগল।
ভাবলাম অপেক্ষা ফুড়াল, কিন্ত না-
কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম
ষষ্ট ইন্দ্রিয় সচল হলেও শারীরিক ভাবে আমি একাবারেই অক্ষম।
আমার নিজের উঠার, বসার, হাটার, খাবার খাওয়ার কোন শক্তি নেই
শুধু এক জায়গায় শুয়ে থেকে হাতপা ছুড়াছুড়ি।
আবার অপেক্ষা শুরু-
ধীরে ধীরে একসময় আমি সব শক্তির অধিকারী হলাম।


ভাবছেন এবার বুঝি আমার অপেক্ষা ফুড়াল,
না মোটেই না-
বরং এর পর শুরু হল আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার
মানুষ হয়ে উঠার অপেক্ষা।
বড়ই কঠিন আর ক্লান্তিকর সে অপেক্ষা।
আমাকে বুঝান হল আমি নাকি এখনো পরিপূর্ণ মানুষ নই।
মানুষ হতে হলে আমাকে পড়তে হবে, জানতে হবে, লিখতে হবে,
ঘুরতে হবে, দেখতে হবে, সাধনা করতে হবে,
পরীক্ষার মুখুমুখি হতে হবে, অর্জন করতে হবে ডিগ্রী।
একেকটা বছর পার করি একেকটা ক্লাশ শেষ করি
আর অপেক্ষা করি নতুন বছরে আরেকটি নতুন ক্লাশের।
এভাবে এ ক্লাশ থেকে সে ক্লাশ, এ স্কুল সে স্কুল,
কলেজ থেকে ভার্সিটি, কত শত শিক্ষকের সানিধ্যে,
সাহিত্য, দর্শন ধর্ম, বিজ্ঞান,চিত্রকলা সহ আরও কত বিষয়ের উপর
শত শত বই পড়ে, কত শত দিনের পরিশ্রমে, কত রাত জেগে,
হাজারো পরীক্ষার মাধ্যমে অবশেষে সমস্ত ডিগ্রীগুলি যেদিন বগল দাবা করলাম
প্রশান্তির এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম, ‘যাক বাবা বাঁচা গেল,
আমার অপেক্ষা শেষ হল’।
কিন্ত হায়! কে জানিত, এর পরও জীবনের বাকে বাকে
আরও এত এত অপেক্ষা আমার জন্য ফুলের মালা হাতে দাড়িয়ে আছে।


ডিগ্রিগুলি পাওয়ার পর কিছুদিন বেশ ভালোই যাচ্ছিল।
এরপর আরও কিছুদিন গেল, দেখি সবাই আমার দিকে
কেমন করে তাকাচ্ছে!
বুঝলাম আমার কর্মহীনতা গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে।
উঠে পরে লাগলাম একটা চাকরির জন্য।
হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম একটা মানসম্মত কাজ।
কত জায়গায়, কত প্রতিষ্ঠানে যে পরীক্ষা আর ভাইভা দিলাম!
অপেক্ষা করতে থাকলাম ডাক পাওয়ার জন্য।
কিন্ত এই অপেক্ষা আর শেষ হয়না।
কোথা থেকেই কোন সাড়া নেই,
বয়সটাও যাচ্ছিল হু হু করে বেড়ে।
অবশেষে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল, খুব ভাল একটা জায়গায় চাকরির সুযোগ হল।
আমি খুব খুশি, আর কোন অপেক্ষা নেই।


কিন্ত না, অপেক্ষা শেষ হয়নি।
কেমন যেন খালি খালি, একা একা লাগে।
বুঝলাম, সঙ্গি দরকার।
আবার অপেক্ষা শুরু, আবার খুজাখুজি।
হাজারো মেয়ের ভীর, কিন্ত বিয়ে করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়না।
দয়া হল একজনের, টেনে  নিলাম বুকে, অপেক্ষা মুক্ত হলাম।


শিক্ষিত হলাম, চাকরি পেলাম
বিয়েও করলাম। আর কিসের অপেক্ষা?
বউ বলল বেবি নেব, মা হব।
আমিও চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম
আমার অনেকগুলি ছেলে মেয়ে, কি মিষ্টি তাদের চেহারা
আমার চারপাশে দৌড়া-দৌড়ী করছে, বাবা বাবা বলে কেউ বুকে এসে পড়ছে।
বন্ধের দিনগুলোতে সবাই মিলে ঘুরতে যাচ্ছি, নভ থিয়েটার, চিরিয়াখানা কিংবা যাদুঘরে।
মজা করে গল্প বলছি আর সবাই চোখ বড় বড় করে শুনছে।
এককথায় রাজি হলাম।
শুরু হল বাবা হওয়ার অপেক্ষা।


একদিন এল সেই মহেন্দ্রক্ষন,বাবা হলাম।
কি যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন।
আমার ঔরসজাত সন্তান শুয়ে আছে আমার সামনে!
হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে!তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল-‘ও পৃথিবী শুন,
আমি বাবা হয়েছি!’


নিশ্চয় এবার ধরেই নিয়েছেন আমার অপেক্ষার এখানেই সমাপ্তি।
হলে ভালোই হত।
জীবন বড়ই বিচিত্র, বড়ই রহস্যময়।
কোনভাবেই সে মানুষকে সস্থিতে থাকতে দেয়না।
একটা অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে হাজারো অপেক্ষার পশরা সাজিয়ে সে হাজির হয়।


এবার শুরু হল আমার ছেলেমেয়দের উজ্জল ভবিষ্যৎ দেখার অপেক্ষা।
সে এক ভায়বহ যন্ত্রনাদায়ক, একই সাথে অনিন্দ সুন্দর অপেক্ষা।
আবার অ, আ, ক, খ, এ, বি, সি, ডি পড়া শুরু করলাম
ছোটবেলার ছড়া, কবিতা, গল্পগুলি কতবার করে যে পড়লাম
কতবার করে যে ১,২,৩, ৪, যোগ, বিয়োগ, গুণ ভাগ করলাম,
ছেলে মেয়েদের শেখাতে গিয়ে।
আবার প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করলাম
ছুটাছুটি করা শুরু করলাম এ স্যারের বাসা থেকে ও স্যারের বাসায়
তাদের দিয়ে আসতে এবং নিয়ে আসতে হয় যে!
আরও কত কি যে নতুন করে আবার করলাম তা আর না বলি।


দেখতে দেখতে তারা বড় হল, যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠাও পেল
বিয়েও হল, খুবি ধুমধামের সাথেই তাদের বিয়ে দেলাম।
তারপর, কেউ চলে গেল শ্বশুর বাড়ি, কেউবা দেশের বাইরে
কেউবা আবার চাকরির খাতিরে স্ত্রী সন্তান সহ অন্য কোন শহরে।
বাড়িতে পড়ে রইলাম শুধু দুই বুড় আর বুড়ি।
একদিন বুড়িও চলে গেল না ফেরার দেশে।
পড়ে রইলাম আমি শুধু একা, সম্পূর্ণ একা।


আমার এই দীর্ঘ জীবনের পথপরিক্রমায়
অপেক্ষা আমার পিছু ছাড়েনি এক মুহূর্তের জন্যও।
ছোট বড় অজস্র অপেক্ষার অলি, গলি, মাঠ, নদী, সাগ্‌র, পাহাড় পেরিয়ে
আজ আমি জীবনের শেষ বিন্দুতে উপনীত।
আজও আমি অপেক্ষায় আছি
কোন কিছু পাওয়ার অপেক্ষা না,
অনন্ত যাত্রার অপেক্ষায়।


জীবন তুই কি শুধুই একটি অপেক্ষা?