খোকা ছিলো আমার সবচেয়ে দামী ধন,
বলতে পারো একটা সুবিশাল পাহাড়!
যার কাছে  এসে দাঁড়ালে নিজেকে নিরাপদ মনে হতো।
যার গায়ের গন্ধে আমার ঘুম আসতো!
খোকার দুষ্টুমিটাও ছিলো অন্যরকম,
সবার থেকে আলাদা,তবে আমার পছন্দের বাইরে না।
সেদিন দুজনের মাঝে কোন দূরত্ব ছিলো না!
ছিলো ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর, যার ভিতরে খড়-কুটোর এক নীড়,
যেখানে খোকার শৈশব বয়ে চলেছে অবলীলাক্রমে।
লক্ষকোটি ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়ে একসময়  বড়ো করলাম তাকে,
পড়ালেখা শেষ করে খোকা কি এক বিদেশী কম্পানীতে চাকুরি নিলো।
তখন কুঁড়েঘরটা ভেঙে একটা বিল্ডিং বানালাম!
বছর চারেক পর,
                 শ্বেত পদ্মের মতো সুন্দর এক অপ্সরীর সাথে খোকার বিয়ে হলো।
সংসারটা হলো দু থেকে তিন,
তখন থেকে আমার গুরুত্বটাও বিলীন হতে লাগলো!
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে,আর  ডাকতো না খোকা,মা বলে।
ভাবতাম মা ডাক যে কতো মধুর,  খোকা হয়তো তা ভুলে গেছে!
ভীষণ  অভিমান হতো খোকার উপরে!
কিন্তু তাতে কোন অভিযোগ ছিলো না!
বছর ঘুরতেই খোকা বাবা হলো,
খোকার মতো আরেকটা খোকাকে পেয়ে,
আমি যেন নতুন এক ভালোবাসার সন্ধান পেলাম।
সেদিন থেকে দাদু ভাইয়ের দেখা শুনার
পাশাপাশি ঘরের বাকি কাজ গুলো আমিই করতাম।
দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিলো!
বছর দশেক পর,
                  আমি হয়ে গেলাম একটু বৃদ্ধ!
ঘরের কাজ আমাকে দিয়ে আর হতো না!
অসুস্থতা যেন শেওলার মতো ধরেছিলো আমাকে!
তখন খোকা প্রায়ই বলতো,তোমার অসুস্থতা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত!
আর কতো সহ্য হয় বলো?
তার চেয়ে ভালো বৃদ্ধাশ্রমে চলো,
তারাই না হয় দেখবে তোমাকে!
খরচটা না হয় আমি দিবো।
তখন কাতর কন্ঠে শুধু বলিলাম,
                            খোকা তোর হয়তো মনে নেই পুরানো দিনগুলোর কথা,
তোকে কাঁধে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে বেড়িয়েছি আমি,
তোর কষ্ট হবে ভেবে একটিবারের জন্যও কখনো কোল ছাড়া করিনি!
গর্ভধারণ থেকে শুরু করে,  কি না করেছি  তোর জন্য!
বুকের দুধ পান করিয়ে তোকে করিলাম বড়ো,
আজ তোরই আঘাতে এ হৃদয় ক্ষত বিক্ষত!
তবু মাথা নতো করে বাঁচতে শিখিনি আমি!
খোকাকে বলিলাম,তুই যদি তাতেই খুশি হোশ,
তবে আমার আপত্তি দেখিবার দরকার বৃথাই!
এ কথা শুনে বউমা বলে,চিন্তা করিছেন কেন,
প্রতিমাসে একবার করে দেখিতে যাবো আপনাকে,
যতো যা ই হোক, আপনাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না!
দুজনের মতামতে পাঠানো হলো আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে।
যাবার সময় দাদুভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলো!
দাদু আমার অতো কি আর বোঝে!
বুঝলে হয়তো সে ও কাঁদতো না!
যেমন কাঁদেনি খোকা।
বৃদ্ধাশ্রমে আমার মতো অনেকেই আছে,শুধু নেই খোকা।
কাউকে অভিযোগ করিবার ইচ্ছা  আমার হয় নাই!
যারা আমার ছিলোনা, তাদের চিন্তাও আজ আর করি না!
          মাঝে মধ্যে মনে হয়,
খোকাকে মানুষ করিবার শাস্তি ভোগ করিতে এসেছি এখানে।
পৃথিবীর সব দুঃখী মায়ের সাথে,হয়তো এ জীবনের তরী শেষবারের মতো জেগেছে।