ওই অগুনতি কালো মাথার জনসমুদ্রে আগুনের গন্ধ টা বুঝি আমিই পেয়েছিলাম আগে ভাগে। দিন টি আর পাঁচ টা সাধারণ ফর্মুলা মানা দিনের মতই।
সূর্য টার ঘুম ভেঙ্গে ছিল ঊষার নিয়ম রীতি মেনে । বাতাসেরা যেরকম গরমের অত্যাচারে ছুটতে ভয় পায়, ভ্যাঁপসা গরমে বাতাস টা ও ঘাপটি মেরে অস্থির হয়ে ফুঁসছিল।এটাও ছিল স্বাভাবিক।ঠা-ঠা রোদে তাঁতিয়ে ওঠা মাটির বুক টা একটু বেশিই কাঁপছিল, তবে রিখটার স্কেলে সেই কম্পন ধরা যাবে না।
একটা লাল রক্তে লেখা হলদে খামে কিছু অপ্রত্যয়ী সন্দেশ পাঠিয়ে ছিল বিকালের ডাক।অক্ষর গুলো অস্পষ্ট রহস্য হাতের ছায়ায় মুদ্রিত,কাফনের গন্ধ মাখা, নাচমুখি অক্ষর গুলো কি জওয়ালামুখি জলপ্রপাত থেকে উঠে আসা মৃত্যু দূতের বেল লিপি ?


আমি চৌরাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে। ইস্টেশনের গা ঘেঁসে যে জন জোয়ার নেমে গেছে তাতে সামিল হতে দেখি এক সন্দেহজনক আগুন্তুকের ছবি।
সে কি বিকালের রক্ত চিঠির সাংকেতিক মুখ? কি রহস্য অগ্নিকোণ ?
আমি ছুটে চলি ওর পিছে ধাওয়া করতে, আমার বুকের ভিতর ভার করে সহস্র শবাধার ।আমি অনুভব করি মরদেহের শীতলতা।একটি জটলা থেকে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাই, আমি রুদ্ধশ্বাসে জন প্রাচীর ভেদ করার চেষ্টা করি।
একটা মৃত্যু আঁশটে পিষ্টে আঁকড়ে ধরেছে এক অপরিচিত মুখ, চোখ পাথরের মত স্থির, শ্বাস স্তিমিত না চলার মতই, হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি লুপ্তপ্রায়, শুধু গোঙানির অস্পষ্ট আওয়াজ...কি যেন বলতে চাইছে ?
কিন্তু অসহ্য জিপটান টেনে নিচ্ছে কথাগুলোকে ভিতরের দিকে। আমি নাড়ির গতি মাপার চেষ্টা করি...হঠাৎ দুচোখ বুজে আসে । রহস্য মৃত্যু পথ যাত্রীর ঠিকানাও অজানা রয়ে গেলো।


হঠাৎ রহস্যের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠলো পুনরায়,মৃতের হাতে দেখলাম সেই সাংকেতিক হলদে খাম।আমি রহস্যের নীল অন্ধকার, বুকে চেপে ঘরে ফিরি,দেখি বিদ্যুৎ নেই...হেলানো চেয়ার টায় চোখ বুজে সেই রহস্যাবৃত ধাওয়া করা আগুন্তুকের ছবি মেলানোর চেষ্টা করি। পিলসুজের মৃদু আলোয় হলদে খামের রক্ত লিপি দেখি বার বার।এই যেন সেই বিকেলের ডাকে পাঠানো একই সন্দেশ বার্তা।হঠাৎ টেলিফোন টা বেজে ওঠে,  আমি ওপারে এক অচেনা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই,
“মরণ দুয়ারে একে একে ৫১...টার্গেট ১০০,সাত ঘড়া তিনের প্যাচ উনিশে বৃত্তান্ত। তারপর টেলিফোনের লাইন কাটার ঝপাং আওয়াজ,আমি হ্যালো হ্যালো করতে থাকি খানিক টা সময় ধরে। কথোপকথন জমা রাখা ছিল মস্তিষ্কের রিসেপ্টারে, আমি রক্ত অক্ষরের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি। মৃত্যু রহস্য আরও ঘনীভূত হয় ঘন কাল অন্ধকারে।আমি লেখার চেষ্টা করি অক্ষর গুলি পাশাপাশি জুড়তে।


“১A,৫১-১০০,৭০০০১৯”ঠিকানা টা দমদমের এক গোরস্থানের।


আমি হলদে ট্যাক্সি টায় চেপে সটান চলে যাই সেখানে। রাত ১টা ২৫ খাঁ খাঁ নিস্তব্ধ শুনশান চারিধার!অন্ধকার কাল রাত্রি! সূচি ছিদ্র গলেও আলোর দেখা নেই ।
আমি সিগারেট টানতে থাকি, আর তার আলোয় দেখি একটি কবর ঘিরে কিছু অন্ধকার ছায়ার ফিসফিস আওয়াজ। আমি প্রাণভয় বিপন্ন করে এগিয়ে যাই কবরেরে গায়। ততক্ষণে সরে গেছে আগুনে ছায়ারা । আমি আবার দেখতে পাই
সেই হলদে খাম আর তাতে লেখা কথা গুলোর ইঙ্গিত স্পষ্ট “রহস্য সন্ধানী...দেখি তোমার দৌড়...” ।
আমি টর্চের মৃদু আলোতে দেখি কবরের গায়ে লাগানো নেম প্লেট, “লেট. অনারেবল লেফটেন্যান্ট আব্দুল রহমান, ১৯২৫-১৯৯৯” ।


আমি সন্ধান করি আব্দুল রহমান সাহেব এর ঠিকানা। তারপর তার বাড়িতে গিয়ে শুনি চুরি গেছে তার জীবিত কালে পাওয়া স্বর্ণ পদক।
গতকাল বিকেল থেকেই উধাও তার একসময়ের পরিচর্যা কারী ভৃত্য দয়াল বাবু,
আব্দুল সাহেবের মৃত্যুর পরেও বেশ কিছুটা সময় ধরেই সে রয়ে গেছে এই বাড়িতেই ...রহস্য ঘনিয়ে ওঠে তাজা রহস্যময়তার অচিন গন্ধে।
আমি মেলানোর চেষ্টা করি গতকালের আগুন্তুকের মৃত মুখ। বাড়ির লোকের বর্ণনা থেকে হবুহু মিলে যায়।
এরপর পুলিশ ফাঁড়িতে খোঁজ নিয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত হই ওই আগুন্তুকের ব্যাপারে, ইনি দয়াল বাবু।


শুধু ভাবতে থাকি এই রহস্যময়তার ঘন অন্ধকার, হলদে খাম, রক্ত লিপি। আমি বাড়িতে ফিরি ইতস্তত: মনে...কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাই না।অথৈ জলে আমার ভাবনারা...আমি রাতের কবরের চিঠিতে আবার চোখ রাখি আরেকবার। সাথে সাথে আবার রওনা হই কালকের গোরস্থানের উদ্দেশ্যে।


সময় রাত ১২ টা ২৫ ।
টর্চের আলোয় দেখি একটি ট্রেনের টিকিট পড়ে আছে কবরের গায়... “বারাসাত
টু শিয়ালদহ”। আব্দুল সাহেবের ভৃত্যর আদি নিবাস বারাসাত। আমি গোরস্থান থেকে রওনা হই বারাসাতের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে ওর ছেলের কাছে খোঁজ নিয়ে জানি আব্দুল সাহেবের একমাত্র প্রিয় পাত্র ছিল তার ভৃত্য, ওর বাবাকে আব্দুল সাহেব তার স্বর্ণ পদক মরার আগে ওকেই দান করে গেছিলেন । আব্দুল সাহেবর ছেলে এসেছিলেন দিন সাতেক আগে বাবা কে নিয়ে যাবার জন্যে আর ওদের মধ্যে কিছু লেন দেন নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছিল। অবশেষে বাবা কলকাতার গিয়ে ছিলেন তার সাথে । তারপর তার কাছে শুনলাম মৃত্যু সংবাদ।


আমি কলকাতায় ফিরে এসে সোজা আব্দুল সাহেবের ছেলের বাসায় যাই।
দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবি ফ্রেম দেখে দেখতে পাই ভিড়ের থেকে উধাও হওয়া সেদিনের আগুন্তুকের মুখ ।আব্দুল সাহেবের ছেলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তারপর হেসে বললেন তাহলে রহস্যজাল নিশ্চিত খুলে ফেলেছেন। আমি বললাম হ্যাঁ । আমার সাথে বাবার পাওয়া স্বর্ণ পদক রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ঝামেলা চলছিল দয়াল বাবুর সাথে, তাই স্থির করি ওটাকে বিক্রি করবো বলে বিদেশে চালান কারি এক ব্যবসায়ীর কাছে মোটা দামে।


আর তাই শশ্মানের ঠিকানা সাংকেতিক অক্ষরে হলদে খামে পাঠান, আমার কাছে যাতে করে চুরির নাটক সাজিয়ে হলদে খামে চিঠি পেয়ে সন্দেহ জাগে আমার মনে।


হ্যাঁ ঠিক তাই। আমি চুরি করে স্বর্ণপদক নিয়ে পালানোর সময় দয়াল বাবু দেখে ফেলেন আর আমার পিছু নেন। তারপর আমি যাকে বিক্রি করি তাকে হাঁতে নাতে ধরে ফেললে, পুলিশ কে জানাবে বলে দেয়। তখন ই কথা কাটাকাটির সময় উনিই গুলি চালিয়ে দেন দয়াল বাবুর উপর। আমি ভিড় থেকে উধাও হয় সব+ন পদক নিয়ে। তারপর আপনাকে ফোন করে গোরস্থানের খবর টা আমিই দিই আর ওখানে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে স্বর্ণপদক রেখে আসি।


আমি কিন্তু গতকাল রাতেই কবরের গা থেকে স্বর্ণপদক উদ্ধার করে নিয়ে জমা করেছি পুলিশ স্টেশনে।ওখানে অগোছালো মাটি দেখে আমি পুরোটা খুঁড়ে ওটা পাই।
আর ওখানেই রেল টিকিট দেখতে পেয়েছিলাম। তাই নিশ্চিত হবার জন্যে আমি বারাসাত যাই।
ততক্ষণে লাল বাজার থেকে পুলিশ ফোর্স এসে গেছে ।।