আজকের এই আন্তর্জাতিক বাংলা কবিতা উৎসবের মাননীয় সভাপতি, প্রধান অতিথি মহোদয়, বিশেষ অতিথিবৃন্দ ও আয়োজকবৃন্দ সহ উপস্থিত সবাইকে আমার পক্ষ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই আজ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন জানি। দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের ফাঁকে সময় বের করে এই যে আপনারা আজকের অনুষ্ঠানে এসে সমবেত হয়েছেন, তা কবিতার প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ। আপনাদের মতো সশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও এখানে আমাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রতি যারা নিরলস শ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে আজকের এই অনুষ্ঠানকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে এধরণের একটি কর্মযজ্ঞ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা বেশ কঠিন এক কাজ।


আমাদের বাংলা-কবিতার আসরের ব্যানারে ইতিপূর্বে এমন বৃহৎ পরিসরে সম্মেলন হয়েছিলো ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বাংলাদেশের ঢাকায়। তারপর করোনার ভয়াল গ্রাসে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ লম্বা এক সময় পার করেছে পুরো বিশ্ববাসী। আমরা প্রত্যেকেই করোনার নির্মম প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছি এই সময়ে। অনেকেই হারিয়েছি প্রিয় আপনজন। সঙ্গত কারণেই তাই আসরের পক্ষ থেকেও সদস্যদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিলো যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের। এভাবেই বেশ ক'বছর পার করে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করছি যে অনেকে টুকটাক নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজনও করছেন ইদানীং। তবে আজকের এই আন্তর্জাতিক বাংলা কবিতার উৎসবের মাধ্যমে অনুভব করতে পারছি যে করোনার ক্রান্তিকালকে অবশেষে আমরা সত্যিই পিছনে ফেলে আসতে পেরেছি। জীবন ধারায় আবারও ফিরে এসেছে চিরায়ত সেই প্রাণের স্পন্দন! সেই সাথে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আশা' কবিতার সেই চার লাইনকেই যেন আরও গভীরভাবে আজ উপলব্ধি করতে পারছি:


মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়
আড়ালে তার সূর্য হাসে।
হারা শশীর হারা হাসি
অন্ধকারেই ফিরে আসে।


চরম বিপর্যয়ের মাঝেও কবিরাই তো এভাবে আশার কথা শোনান। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান আরও সামনের দিকে। পথ হারাতে হারাতে আমরাও খুঁজে পাই নতুন পথের দিশা।


কবি ও কবিতার জন্য আমাদের যে অনলাইন আসর, দেখতে দেখতে তারও চলার পথের ১৩টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। এই সময়ের মধ্যে আমরা যেমন নতুন নতুন অনেক সদস্য পেয়েছি, অনেকেই আবার নানা কারণে আসর থেকে বিদায়ও নিয়েছেন । অনেকে পৃথিবী থেকেই নিয়েছেন চির বিদায়। পেছনে রেখে গেছেন তাদের কবিতা। আসরে মানুষের পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে কবিতায়ও। কিন্তু কবিতা চর্চার প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থেকেছে পরিবর্তনের এই চিরন্তন স্রোতের মাঝেও। এই প্রক্রিয়া আমাদের আসরের অস্তিত্বের আগেও গতিশীল ছিলো, এবং ভবিষ্যতেও কোনো না কোনো মাধ্যমে গতিশীল থাকবে নিশ্চিত। মনের পুঞ্জীভূত অনুভূতিগুলোকে সুনিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে কবিতার আকারে প্রস্ফুটিত করার এই মহাযজ্ঞকে আমাদের কবিতা লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াসে আরও মহিমান্বিত করতে না পারলেও, এতে অংশ নিতে পেরে আমরা নিজেরাই সার্থক হয়েছি নিঃসন্দেহে।


কবি আবিদ আনোয়ার তার 'সনাক্ত-চিহ্ন' কবিতায় মানব জীবনকে সাগরের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করেছেন। বলেছেন:


মূলতই ঢেউ মানে সমান জলের স্ফীতি, অভিন্ন কলকল,
খোঁজে একই তট,
অবশেষে মাথা কুটে বিরস বালুতে লুপ্ত হয় গতির দাপট ।


কবির সাথে আমিও একমত। সাগরের ঢেউয়ের মতো আমরাও বিলুপ্ত হবো। কিন্তু হয়তো আমাদের কারো কারো কবিতা সাগরের পাড়ে নুড়ি হয়ে থেকে যাবে আরও বহুদিন। পূর্ববর্তীদের অনুভূতি ও বার্তাকে পৌঁছে দেবে পরবর্তীদের কাছে। সত্যি বলতে কবিতাই টিকে থাকে। ভাষার লিখিত যে রূপ হাজার বছর পার হয়ে এখনও টিকে আছে, তার বেশিরভাগই দেখবেন কবিতা বা শ্লোকের আকারে লেখা। হোক না তা কোনো ধর্মগ্রন্থ, অথবা কোনো সাহিত্যকর্ম। ইতিহাসের বাকি সব কিছু সময়ের সাথে পরিণত হয়েছে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার বিষয়ে। আমি বলবো না যে আমাদের প্রত্যেকের কবিতাই এভাবে কালজয়ী হবে। আমাদের অনেক লেখা হয়তো আসলে কোনো কবিতাই হয়নি। কিন্তু কবিতা লেখার এই যে অদম্য এক স্পৃহা, মনের কথাটিকে সুললিত শব্দের মালায় প্রকাশের আন্তরিক প্রচেষ্টা, তা অবশ্যই সম্মানের দাবী রাখে।


কবি জীবনানন্দ বলেছেন, "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।" সত্যি বলতে কবি হওয়ার জন্য কোনো শিক্ষাক্রম নেই। এমন কোনো পাঠ্যসূচী নেই যা আয়ত্ত করে পরীক্ষায় পাশ করলেই রাতারাতি কেউ কবি হয়ে যাবো। কবিতা মনের ভিতর থেকে উঠে আসে। যার আসে তার আসে। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এই কবিতাকেই আরও সুন্দর, আরও পরিশীলিত ও মনোগ্রাহী করে তোলা সম্ভব। সেজন্য চাই নিবিড় মনোনিবেশ, চাই কবিতা চর্চার অনুকূল পরিবেশ। প্রয়োজন সমমনাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান, কবিতা নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ। সেই সাথে প্রয়োজন পাঠকেরও। আর প্রয়োজন কিঞ্চিৎ উৎসাহের। আমাদের অনলাইন প্লাটফরমের মাধ্যমে এই জিনিসগুলোই আমরা দিতে চেয়েছি আমাদের সদস্যদের। সেই সাথে বাংলা কবিতাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছি বিশ্বের সকল প্রান্তের পাঠকের কাছে। এই লক্ষ্যে আমরা কতটুকু সফল হয়েছি তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। কবিতার চর্চায় ও প্রচারে যদি যৎসামান্য ভূমিকাও রেখে থাকে আমাদের এই আসর, তবে এটা নিশ্চিত যে এই অর্জনে আপনাদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। আপনাদের সকলের সার্বিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণই আসরের মূল উপাদান। আপনাদের এই চর্চা চালিয়ে যান। আমাদের প্লাটফরমে আরও কী কী সুবিধা থাকলে সবার জন্য ভালো হয় তা জানান। চেষ্টা থাকবে আপনাদের আরও সুন্দর ও উপযোগী আসর উপহার দেয়ার।


পরিশেষে আমার একটি কবিতা পাঠ করতে চাই আপনাদের মাঝে। মাতাল সুখ নামের কবিতাটি লিখেছিলাম ২০১২ সালে।


আজ) জীবন সুখের হিল্লোলে
এই) প্রাণ দোলে এই মন দোলে,
আজ) হিমেল হাওয়া ঢেউ তুলে যায়
মন বাগিচার ঝাউ তলে।


আজ) নাচবো রে আজ নাচবো রে,
আজ) নাচের মাঝেই বাঁচবো রে,
আর) নতুন তালের ঝংকারে আজ
নতুন রঙে সাজবো রে।


সব) কষ্ট ছিঁড়ে কষ্ট ফুঁড়ে
জাগলো প্রাণের কোন আলো!
আঁধার ছিঁড়ে জাগলো এ কোন
স্বপ্ন নতুন জমকালো!
সেই) স্বপ্নে আমি বিভোর হয়ে
থাকবো ডুবে থাকবো রে,
দুঃখ-শোকের জীর্ণ জরা
স্বপ্ন দিয়েই ঢাকবো রে।


আজ) দিলেম সকল বাঁধ খুলে,
সব) দুঃখ গেলাম আজ ভুলে,
আজ) মাতাল সুখের প্রলয় নাচন
যাক এ মনে ঢেউ তুলে।


আজকের উৎসবের আবহে ঠিক এমনই এক মাতাল সুখে আবিষ্ট হয়ে আছি আমি এ মুহূর্তে। কবিতার দোলায় দোলায় মাতাল সুখের এই প্রলয় নাচন আপনাদের মনেও আজ ঢেউ তুলে যাক, এটাই কামনা করি। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।


আজকের মতো এখানেই বিদায় নিচ্ছি। ধন্যবাদ!