বাংলা ভাষার পরিচিতি এখন আরও ব্যাপক বিশ্বব্যাপী। বিংশ শতাব্দিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুরের বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর, বাংলাদেশে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলনের পরে গত ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এবং বিশিষ্ট পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালি” ছায়াছবি বাংলা ভাষায় রচিত হওয়ার পর বিশেষ ক্ষেত্রে অস্কার জয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বের আংগিনায় আরও ব্যাপক হারে সমাদ্রিত হতে থাকে। এবং দ্রুতই সমতল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে গিয়েও তার স্পন্দন লাগে।


সমতলের মানুষেরা সাধারনতঃ পার্বত্য অঞ্চলে খুব একটা প্রয়োজন না হলে যায় না। আর যদিও যায় তা হয়ত বড় জোর এক সপ্তাহের জন্য। সেই এক সপ্তাহে কাজের ফাঁকে আর কতটুকুইবা পার্বত্য মানুষের জীবন ধারণ, বসবাস, ঐতিহ্য, কালচার, সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। আজকাল সমতল ভূমির মানুষদের একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরতে যাওয়ার। এ আগ্রহটা গড়ে তোলার জন্য অবশ্য পর্যটনের বিজ্ঞাপন, প্রচার এবং এই শিল্পকে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা এবং বিবিন্ন মহলের পৃষ্ঠপোষকতাকে অশ্বীকার করার জো নাই। সেই ঘুরতে যাওয়াও তো আর সাত আটদিনের বেশী নয়। তাই পার্বত্য বিষয়ে জানতে হলে সেখানে থেকেই যে জানতে হবে তাও বলছি না। পড়াশোনা করেও জানা যেতে পারে। কিন্তু কোন কারনে দীর্ঘদিন সেখানে থাকার আবশ্যকিয়তা হলেঞ্জানাটা আরও সমৃদ্ধ হয়। তবে এখানেও সে অবস্থাঙ্কারী ব্যক্তির একটা উতসাহ কজ করতেই হবে সেই পার্বত্য অঞ্চলের সমাজ ব্যাবস্থা ও প্রাত্যহিক জীবন্ধারার উপর।


চাকুরীর সুবাদে আমাদের বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও বিদেশের বিভিন্ন দেশে যেমন সাউথ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, সিয়ারালিয়ন ইত্যাদি দেশের পার্বত্য অঞ্চলেও আমার সময় কেটেছে। আমি আশ্চর্য হোয়ে দেখেছি যে কিছু মৌলিক বিষয়ের কালচার সংস্কৃতি যেন সারা বিশ্বের পার্বত্য অর্থাৎ পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় একই। যেমনঃ
ক। ঘর বাড়ি খ। গোল ঘরের ব্যাবহার গ। পোষাক ঘ। বাদ্য যন্ত্র ঙ। খাদ্যাভ্যাস চ। বিচার বা সম্প্রদায় প্রধান এর খবরদারিত্ব ছ। উৎসব ইত্যাদি।


আজ এ পর্যায়ে সিয়েরালিয়নে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রিয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানে আগে এ ভাষাকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে আমারও কিছু অবদানের ঘটনা বলতে পারি।  ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যখন ঘোষণা করা  হয় তখন আমি এই সিয়েরালিয়নে জাতিসংঘ সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সামনেই ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী। মনে পড়ে গেল বিগত স্কুল কলেজ জীবনে প্রভাত ফেরীর কথা। ইতি মধ্যে সিয়েরালিয়নে জাতীয় নির্বাচন সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজের সুবিধার জন্য আমাদের বাংলা ভাষাতেই অনেক কার্য্যক্রম স্থানীয় প্রশাসনের সাথে শুরু করতে আমরা ব্ধ্য হয়েছিলাম। কার সাধারণ সৈনিকেরা ইংরেজীতে স্বচ্ছন্দ নয়। স্বভাবতঃই আমাদের মুখের ভাষা বাংলা ভাষাকে ব্যাবহার করে কি ভাবে স্থানীয়দের নিয়ে কাজ এগিয়ে নেয়া যায় তার তোড়জোড় আমরা শুরু করে দিই বাংলাভাষায় কথা বলে, বাংলাভাষা স্থানীয়দের শিখিয়ে এবং গানো সুরের মাধ্যমে। তো আমার মনে হতে লাগল বিদেশ বিভুঁইতে হলেও যেহেতু আমাদের ভাষা আন্দোলনের ফসল আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা আজ ইউনেস্কোর দ্বারা স্বীকৃতি পেয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিয়েছে সেহেতু আমরা বাংগালিরা এখানে থাকা অবস্থায় তারা জানবে না আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা অধিকারের লড়াই ও অর্জন তা কি করে হয়। আমি তখন সিয়েরালিয়নের উত্তরে পার্বজ্য জেলা কাবালাতে কর্মরত। ভারী সুন্দর জেলা। চারিদিকে পাহাড় পর্বত “ওয়ারাওয়ারা” দ্বারা পরিবষ্টিত। গরমের সময় দক্ষিনের বিশেষ করে রাজধানী শহর “ফ্রী টাউনের” ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এখানে শীতল হওয়ার সময় অবকাশ কাটাতে আসে। কারন এ সময়টাতে এখানে প্রকৃতিতে ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে। এ শহরে যেখানে আমাদের ক্যাম্প সেখানেই স্থানীয়দের জন্য একটা খেলার স্টেডিয়াম ছিল। আমি আমার ক্যাম্পের সকলেই আগের থেকেই বাংলা কথাই বলতাম ওদের সাথে। তারা শুনতে শুনতে বুঝতে বুঝতে অনেকেই ভাষাও রপ্ত করে ফেলেছিল এত দিনে। ফলে আমার সুবিধাও হল। আমি স্থানীয় ছোট ছোট প্রায়  ২০ জন ছেলে মেয়েদের গামছা ফতুয়া লুংগী কিনে “কারার ঐ লৌহ কপাট”, “সাধের লাউ বানাইলি মোরে বৈরাগী”, “ একতারা বাজাইও না দোতারা বাজাইও না...... একদিন বাংগালি ছিলামরে “ এমন সব গান শিখিয়ে তার সাথে বাংগালি নাচ শিখালাম।


২১শে ফেব্রুয়ারী সকালে ছোটদের মাঝে ফুটবল প্রিতী ম্যাচ, বিকেলে বড়দের সাথে ভলিবল ম্যাচ এবং রাতে ঐ সকল নাচ গান দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । তার আগে অবশ্য পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে প্রায় ৭০/৭৫ টা স্লাইডের মাধ্যমে কম্পিউটারে ইফেক্ট দিয়ে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশের পোষাক শিল্প, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বানিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সকল বিষয়ে তুলে ধরি। তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। এ সফরেই আমি আমার লিখা বিখ্যাত আধুনিক পল্লীগীতিঃ “ পরবাসে একা একা ঘুম আসে না, তুমি ছাড়া কোন কাজে মন বসে না”  লিখে সুর করে গেয়েছিলাম ফোর্স কমান্ডার জেনারেল উপান্ডের সামনে। জেনারেল সাহেব বাংলা একটু একটু  বুঝেছিল কি না তা জানি না। তবে গানের সুর আর লয়ে তিনি এতই মুহিত হয়েছিলেন যে আমাকে পরে সেই গান ইংরেজীতে রিট্রান্সলেট করে দিতে হয়েছিল। এর পরে আর থেমে থাকিনি  বিভিন্ন জায়গায় আ্মাদের গানের অনুষ্ঠান সহ চলচ্চিত্র প্রদর্শন, কথপোকথন সব  চলতে থাকে বাংলায়। উত্তর থেকে দক্ষিন, পূর্ব থেকে পশ্চিম যে যেখানেই বাংলা দেশের সেনাবাহিনীরা কর্মরত ছিল সকলেই বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করে গেছে। শেষের দিকে আমি কিছু মসজিদ নির্মান, স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং গীর্জার সংস্করণও করে দিই ফলে বাংগালি সেনাবাহিনী, বিমান এবং নৌ-বাহিনীর উপরে তাদের ভালোবাসা দিন দিন বাড়তে থাকে। আর এর পেছনে হয়ত আর একটি কারন সেটা হল যে, সিয়েরালিয়নের মানুষ প্রায় ৭০% মুসলিম এবং প্রায় প্রতিটি সড়ক দ্বীপেই মসজিদ ছিল। আর তারা দেখত যে অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের আচার আচরণে পার্থক্যও চোখে পড়ার মত। কারন আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আল্লাহ্‌র কালাম পড়ি। মদ খাই না, নারীদের ইজ্জত করি। নাইট ক্লাব এড়িয়ে চলি। এ সকল কারনেও হয়ত বাংগালি সেনাদের প্রতি তাদের স্রদ্ধা ছিল অগাধ। যা আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্যকে গ্রহনীয় করে তুলতে অনেকাংশে সহায়তা করেছে।


পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতির বাস্তব অবস্থাকে উপলদ্ধি করে দেখা যায় যে, সংস্কৃতি আসলে শেখার বিষয়। ভাষার রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক অধিকার। পৃথিবীর যে সমস্ত ভাষা রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে মোকাবিলা করতে পারেনি সেই সমস্ত ভাষাগুলির অনেকেই হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং আগামী দিনেও যাবে। রবীন্দ্রনাথ এই সকল ভাষাকে ”ভাষাদীন” বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বাংলাদেশে ৪৫ টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। শত শত বছর ধরে এদেশে এসব জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আপন আত্মীয়ের মতই বাঙালিদের পাশাপাশি একত্রে বসবাস করেও আসছে। যদিও তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলদা সংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য। এসব জনগোষ্ঠী উপজাতি নামে পরিচিত । পাহাড়,  সমতল, সমূদ্র অঞ্চল ও বনভুমিতে তারা বসবাস করে। বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি উপজাতি হল-
১।চাকমা ২। মারমা ৩।সাঁওতাল ৪। গারো ৫।মণিপুরি ৬।মুরং ৭।খাসি ৮।হাজং ৯।ওঁরাও ১০।রাজবংশী
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। চাকমাদের  আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, অরুণাচল, ত্রিপুরা, আসাম ও মিয়ানমারে রয়েছে। আঠারো শতকের (১৭৭৭) দিকে চাকমা সাধক কবি শিবচরণ তাঁর গোজেন লামা গীতিকাব্যটি চাকমা বর্ণমালায় রচনা করেছিলেন। অন্যদিকে, ১৮৬০ সালে খ্রিষ্টান মিশনারিজদের উদ্যোগে এলাহাবাদ থেকে চাকমা বর্ণমালায় বাইবেলের অনুবাদ করা হয়। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার হলেও এটি চাকমা বর্ণমালার অন্যতম স্বীকৃতি ছিল, যেটি চাকমা বর্ণমালার ভিত্তিকে আরও মজবুত করেছে।
আমরা জানি, ভাষার লিখিত চর্চা না থাকলে ভাষার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সাহিত্য চর্চা বাংলা হরফে হলেও অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারণগত সমস্যার সমাধান বাংলা দ্বারা সম্ভব নয়। যে দেশের মানুষ মাতৃ ভাষার জন্য প্রান দেয় সেই দেশ অন্য ভাষাভাষি মানুষের মাতৃ ভাষাকে সম্মান দেখাবে না তা কখনই হয় না। সরকার ন্ররজাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে তাই পাঠ্যক্রমের আওতায় এনে তা শিক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ নেয়।
রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে মূলত জুম্মদের সাহিত্যচর্চা শুরু। “রাজমাতা বিনীতা রায় পরিচালিত অরুণ রায় সম্পাদিত ‘গৈরিকা’ পত্রিকায় ১৯৪৬  চাকমা সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। আর বর্তমান কবি ফেলাজিয়া ১৯৭৩ সালে লেখেন চাকমা কবিতার মোড় ফেরানো 'জুম্মবী পরাণী মর' কবিতা। অনেকটা জীবনানন্দের মেজাজ যেন। কবি যখন বলেন,


'জুম্মবী পরাণী মর' (কবিতা)


হলে পঝাগে আ ধগেধাগে/
যদেপদে কধা কদে বাঙালমিলা সান?/
আহ মর পরাণর চম্পক নাগরী!/
কদে চাং কমলে কেঙেরি কুধু তর মর এধকদিন ওইয়ে হারাহারি?/
মোনমুরা ছরাছরি কদকিত্যা ঘুরিফিরি চিপ্পুরেপা আবাধা গরি/
ভালকদিন পরে তুই মইধু এলে,/
কদে চাং জুম্মবী পরাণী মর এধকদিন কুধু কুধু এলে?


বঙ্গানুবাদ :
সাগরের এত জল দুটি চোখে এখনও যে আছে হায়!/আমি তা জানি না!/কবে তুমি সুনয়না, হারিয়েছ প্রিয় আঁখি, মায়াচোখ/কোমল কোমল চাহনি?/জুম্মবী, বলো প্রিয়া, সাজে লাজে কেন আজ কাঙালিনী বেশে?/আহা মোর চম্পা-প্রিয়া, কতকাল পরে দেখা হলো দু'জনের?/কত পথ কত নদী, কত অরণ্য পেরিয়ে/আবার এসেছো হায় এতদিন পরে!
প্রেম ও দ্রোহের যুগপৎ মিলনে আমাদের পাহাড়ি জনগণের জীবনজিজ্ঞাসা কবিতায় রূপ পাচ্ছে। ব্যক্তিসত্তার বিকাশ, অধিকারবোধ, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কবিরাই থাকেন সামনের সারিতে।


চাকমা ভাষায়  চলচ্চিত্র ও টেলিফিল্ম নির্মান করা হয়েছেঃ
চলচ্চিত্রঃ'মর থেংগারি'-চাকমা ভাষায় 'মর থেংগারি' শব্দের অর্থ আমার বাইসাইকেল।
৬৪ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের বাইরেও প্রদর্শণী করা হবে বলে জানান মি. রাখাইন।
টেলিফিল্মেরঃ  'ম মনান হিঙিরি বুঝেম' (মন কী করে বোঝায়) নামে সম্পূর্ণ চাকমা ভাষায় নির্মিত টেলিফিল্মের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। টেলিফিল্মটির প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন স্থানীয় সংবাদকর্মী ও সংস্কৃতি সংগঠক সুপ্রিয় চাকমা শুভ।
আমরা ওপার বাংলা অর্থাৎ ভারতের পার্বত্য অঞ্চল বলতে সাধারনতঃ ওপারের সেভেন সিস্টারকে বেশী বেশী বুঝে থাকি। সেখানেও পার্বত্য সংস্কৃতির সাথে বাংলা ভাষার ব্যাবহার এবং প্রসার সে আদিকাল থেকেই চোখে পড়ার মত।  
সেভেন সিস্টার মনে রাখার কৌশলঃ  “ আমি অমেত্রি মনা ”
আ = আসাম ( গোয়াহাটি ) মি = মিজরাম ( আইজল ) অ = অরুনাচল ( ইন্দিরাগিরি ) মে = মেঘালয় ( শিলং ) ত্রি = ত্রিপুরা ( আগরতলা ) ম = মনিপুর ( ইম্ফল ) না = নাগাল্যান্ড ( কোহিমা )


কোন পরাধীন দেশ বা জাতি যখন নিজে ভিন্ন কোন ভাষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণে আপন ভাষা বিসর্জিত হয় এবং একই সঙ্গে সংস্কৃতিও। আমাদের দেশে ফার্সি, ইংরেজী ও উর্দূর অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলা ভাষার সৌভাগ্য এই যে সে রাজনৈতিক অধিকার মোকাবেলা করতে পেরেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই করেছে। পরোক্ষভাবে যেমন প্রতিনিয়তই তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তেমনি প্রত্যক্ষভাবেও অন্তত দুইবার রাজনৈতিক অধিকার মোকাবেলা করে রক্ত দিতে হয়েছে। প্রথমবার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) উর্দূ ভাষা চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়বার ভারত রাষ্ট্রের অসম রাজ্যে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে। সবগুলো পার্বত্য অঞ্চলে বাংলার প্রচলন তেমন না থাকলেও ভারতে যে পার্বত্য অঞ্চল গুলোতে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের প্রভাব আছে এবং কবি গুরু যে সকল অঞ্চলে সমতল থেকে মাঝে মাঝে ছুটে গেছেন সে সকল ভারতীয় পার্বত্য অঞ্চলে বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু অবতারণা করে যেতে পারেঃ
আসাম (গৌহাটি)ঃ ভাষার বিলুপ্তি মানে সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া আর সংস্কৃতি ম্লানতা হচ্ছে সভ্যতার পরাজয়। একথা ঠিক যে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ভাষার আগ্রাসন ও ভিন্ন সংস্কৃতির আধিপত্য পূর্বতন সময়ের তুলনায় অনেক জটিল। তবুও আমরা যারা ভাষাকে অখন্ড জাতিসত্তার মূল হিসাবে বিবেচনা করি তাদের অবশ্যই আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে যেমন কোন আলোচনা নেই তেমনি নতুন প্রজন্মও অন্ধকারের বাসিন্দা।  ১৯৬১ সালের ১৯ শিলচর শহরের সত্যাগ্রহী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দও আসামের বাঙলা ভাষা আন্দোলনের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য এই সময় মোট ১১ জন শহীদ হয়।


সেই সময় বড় পরিহাসের বিষয় ছিল যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহেরু সেদিন শিলচরেই অবস্থান  করছিলেন। বিষয়-রবীন্দ্রনাথের জন্ম বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। সরকারী এই সভায় নেহেরু রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলা ভাষা অনেক গুনকীর্তন করলেন কিন্তু বাঙলা ভাষার জন্য সেদিন দুপুরে যারা প্রান দিল তাদের জন্য একটি শব্দও ব্যয় করলেনা। যেহেতু বাঙালীরা প্রগতিবাদী চিন্তার অধিকারী সেই কারণে কংগ্রেস নেতৃত্ব বাঙালী জাতি সম্নন্ধে আতংক বোধ করে। নেহেরু সরকার থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভাষা বিরোধের কোন নিস্পত্তি হয়নি। বাংলাদেশের ২১শে ফেব্র“য়ারী আর ভারতের ১৯ শে মে এর ইতিহাস একসাথে পাশাপাশি বহমান থাকবে এটাই প্রতিটি বাঙালীর কাম্য।
”কিন্তু ভারতে এই প্রজন্মের পশ্চিমবঙ্গের বহু বাঙালী জানেন না যে বরাক উপত্যকার বাঙালী ভাষার অধিকারের জন্য রক্তম্লান করেছে।


মণিপুর ( ইম্ফল) ঃ ভারতবর্ষের একটি প্রত্যন্ত প্রদেশ। মণিপুর নামের সঙ্গে পরিচিতি কম-বেশি সকলের কাছে আছে। সেটা হয় মহাভারতের কাহিনির জন্যে না হয় মণিপুরি নাচের জন্য। সাহিত্যের জন্যে তো নয়ই। কিন্তু কতজনই বা খবর রাখেন মণিপুরি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা তথা বাঙালিদের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক একসময় তৈরী হয়েছিল? মণিপুরি সংস্কৃতির পেছনে বাঙালিদের যে একটা অবদান আছে? মণিপুরি ভাষার প্রচলিত অন্যতম লিপি হচ্ছে বাংলা লিপি আর মণিপুরি নাচকে সমগ্র ভারতবাসীদের কাছে পরিচিত করিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্য বিশান্তিনিকেতনই হয়তো প্রথম মহাবিদ্যালয় যেখানে কোনও নাচকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি না মণিপুরি নাচ সম্বন্ধে আগ্রহী হতেন তাহলে মণিপুরি নৃত্যের যে খ্যাতি আজ বর্তমান তা এ অবস্থায় থাকত কিনা সন্দেহের বিষয়।  বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম মণিপুরি নাচ দেখে অভিভূত হন।


মণিপুরি নাটক-থিয়েটারের ইতিহাস একশ বছরের ওপর। ব্রিটিশ রাজত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে শ্রী গোবিন্দজী নাট মন্দিরে স্টেজ বানিয়ে প্রোসিনিয়ম থিয়েটার নামক একটি সংস্থা ‘প্রবাস মিলন’ নামক একটি নাটক প্রথম মঞ্চস্থ করে। ওটাই মণিপুরে মঞ্চস্থ করা প্রথম নাটক। আর ‘প্রবাস মিলন’ মঞ্চস্থ হয়েছিল সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায়।


মেঘালয় ( শিলং)ঃ  খাসিয়া পাহাড়ের  আঁকাবাঁকা উঁচু নিচূ পাহাড়ি পথ দিয়ে ঘেরা মেঘালয়ের শিলং রাজধানী।  এ পথেই দুর্ঘটনায় মুখোমুখি পতিত হয় অমিত আর লাবন্য এবং সেখান থেকেই তাদের পরিচয় এবং প্রেম। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ এই শিলং এর প্রেক্ষাপটেই লিখা এবং এর শুরুটাও এই শিলঙ্গয়েই।  কবি গুরু ১৯১৯ থেকে নিয়ে ১৯২৭ এর মধ্যে প্রায় তিনবার শিলং পরিদর্শনে যান।  শিলং এ মূলতঃ খাসিয়া ও গারোদের আবাস্থল হওয়ায় সেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা এ সব নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ নেই। এই আগ্রহও তৈরি করতে হয় কবি সাহিত্যিকদেরই। যেমন রবীন্দ্রনাথ করেছেন।


যা হোক, বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষি জনসংখ্যা বর্তমানে ৩০০ মিলিয়নের অধিক। অনুমান করা হয়েছে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে ৫০০ মিলিয়নে উপনীত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের বসবাস, চাকরি, বাণিজ্য এবং রাজনীতিতে এঁরা সক্রিয়।
বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষি জনসংখ্যা বর্তমানে ৩০০ মিলিয়নের অধিক। অনুমান করা হয়েছে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে ৫০০ মিলিয়নে উপনীত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের বসবাস, চাকরি, বাণিজ্য এবং রাজনীতিতে এঁরা সক্রিয়।
ভারত আর বাংলাদেশ ছাড়াও বাংলা ভাষা বিশ্বের সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, কানাডা, যুক্তরাজ্য, নেপাল, মিয়ানমার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালাউই, সিয়েরা লিওন(সরকারী ভাষা, ২০০২ সাল এ দাবি) সহ পৃথিবীর যে মহাদেশেই মাংগালি বাস করে সেখানেই ছোট পরিসরে হলেও বাংলা ভাষার চলন আছে। আর বর্তমানে ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় তার বিস্তৃতি আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন করেই যুগে যুগে বিশ্বের সব দেশের সমতল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে সাহিত্য চর্চা এক হয়েছে ভাষা, প্রেম, চাহিদা, সম্পর্ক, আসাযাওয়ার মাধ্যমে। এ কারনেই বলা হয় ভাষা গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল বটে।


বর্তমান বাংলা সাহিত্য তথা কবিতাকে বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলা ভাষাভাষিদের মাঝেই শুধু নয় অন্য ভাষাভাষি কবি সাহিত্যিকদের মাঝেও একটু আধটু আগ্রহী ও সচল করে তোলার জন্য বাংলা কবিতা ডট কম অনেক অবদান রেখে চলেছে সে এর চলার শুরু থেকেই। সেই সাথে এও লক্ষ্য করা যায় যে অনেক সাহিত্য ও কবিতা সংগঠনও এর নেপথ্যে ও সম্মুখে, প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ্য ভাবে বাংলাকে ভালোবেসে, বাংলা বাষাকে ভালোবেসে তথা কবিতাকে ভালোবেসে এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যকে শুধু সমতলেই নয় দেশ এবং বিদেশের সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলেও সমান ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এ চলা অব্যাহত থাক, আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক এর শ্রী এবং উৎকর্ষতা। জয় হোক কবিতার, জয় হোক বাংলা ভাষার এই হোক সকল বাংলা ভাষাভাষি মানুষের একান্ত চাওয়া।


০৬ জানুয়ারী, ২০২০।