মেট্রোপলিটান জীবনে প্রতিদিনের সকালটা কেমন অচেনা অচেনা মনে হয়? অথবা প্রতিদিনের দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কিংবা রাত্রিও কেমন অপরিচিত হয়ে যায়? চারিপাশের বন্ধু বান্ধবীদের খোঁজ নিলেই শুনি সব বিচিত্র রঙয়ের, ঢঙয়ের আর চরিত্রের আলাপন। ফুল পাখি, প্রকৃতি, কবিতা গান বাদ দিয়ে কতক্ষন ভাল লাগে শুধু টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি আর বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া সন্তান অথবা নিকট আপন জনদের গল্প। অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে যেন  সংঘাতপূর্ণ একটা জীবন তাদের প্রতিদিন। কেমন অস্থিরতা, স্থিরতা, অসুস্থতা। নয়ত মুগ্ধতা, উদ্দোমতা, উচ্ছ্বলতা। কখনও নগ্নতা, নিষ্ঠুরতা নয়ত হিংস্রতা আর নিজস্ব সময় নিয়ে অনেক জটিলতা। মায়া মমতা থাকলেও তা ছকে কাটা ডাক্তারী ঔষুধ যেন। মনে হয় বিচিত্র মোড়কের বিজ্ঞাপনে সাজানো এই মেট্রোপলিটান জীবন।    


বর্ষা কালে বৃষ্টি হবে, রাস্তাঘাটে কাদা পানি থাকবে, ছাতা নেই- ব্যাস বৃষ্টিতে ভিজে সারা হতে হবে, এটাই  স্বাভাবিক। অথবা শীতকালে ঠান্ডা লাগবে, গরম কাপড় পড়তে হবে, না হয় ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠবে দরিদ্র জীবন, কখনও কখনও শিহরিত ঠোঁট ফাটবে এটাই প্রকৃতিগত আচরণ। আসলে তখন ডাক্তারি দাগ কাটা ঔষধ আর আম পাতার পৃষ্ঠে চুন আর সরিষা তেলের জ্বলন্ত শেঁকায় গলায় অসুখের উপশম, কত সহজেই জীবনকে স্বাভাবিক আরোগ্যতায় আয়েশ করা যেত। এত ভাবনা নেই, আশংকা নেই, হস্পিটাল নেই, স্পেশালিস্ট ডাক্তার নেই, সিসিইউ নেই। প্রায় একই রকমের অসুস্থতা যেন। তাই গ্রাম্য ডাক্তার মোঃ আজিজার চাচা দাগ কাটা ঔষধ দিয়েছে, ব্যাস  অসুখের বংশ যেন উদ্ধার। একই রোগ শোক, একই ভাবনা, একই অভাব অনটন আর মায়া ভালবাসা। তাই ডিপ্রেশন ছিল না কোন ভাবনার নাম।
    
বাংগালিপনায় মেট্রোপলিটানে যেই এলো ট্যাবলেট, পিল, ক্যাপ্স্যুল, সিরাপ, হস্পিটাল, বড় বড় স্পেশালিষ্ট, আর অমনি জীবন অনুগত  হল আশংকার কাছে, ভয়ের কাছে, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার কাছে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের জন্য এক এক রকমের স্পেশালিষ্ট ডাক্তারের কাছে। কত পরীক্ষা নিরীক্ষা, কত অপেক্ষা, কত দুশ্চিন্তা, কত আশংকা, কত ঔষুধ পথ্য, কত নিয়ম কানুন তার শেষ নেই। সব কিছুই যখন ব্যর্থ হল, তখন হতাসা। ডিপ্রেশন! আজকাল ডিপ্রেশনও একটা  অসুখ। এ অসুখ মেট্রোপলিটান জীবনেই বসবাস করে, ঘুরে বেড়ায় আভিজাত্যের পাড়ায় পাড়ায়। কি ভয়ংকর তার চাল চলন, কি অস্বাভাবিক তার আচরণ আর কষ্ট প্রকাশ। কিছুতেই রুচি নেই। কিছুতে বলতে শুধু খাওয়া পরা আর ঘুম নয়, বরং সব শেষে জীবনকেও টেনে আনে অসাড় জীবনে।


তাই প্রকৃতির কাছে অনুগত হতে শিখতে হবে, যা আদতেই ছিল বাঙ্গালি সমাজ জীবনের স্বাভাবিক চিত্র। তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে শিক্ষাও দিতে হবে, তার গল্প শোনাতে হবে। বেঁচে থেকে যতটুকু পেলাম ততটুকুতেই কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। আমরা কেন ভুলে যাব টিনের চালে পাকা আম পড়া কিংবা বৃষ্টির শব্দ, কেন ভুলে যাব দক্ষিনের জানালা খুলে পূর্ণিমার চাঁদ দেখার দৃশ্য, কেন ভুলে যাব গোবর লেপা উঠোনে পাকা ধান মাড়ানোর গন্ধ, সেদ্ধ ধানের চাতালের গন্ধ? কেন ভুলে যাব হাডুডু, গোল্লাছুট, ফুটবল খেলার মাঠ? কেন ভুলে যাব পাড়াত ভাই-বোন, চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুপা-ফুপি, বুবু-দুলাভাইয়ের আদর অথবা আব্দার? আমাদের ব্যাবহারের মধ্যে আজ অতি কৃত্তিমতা, খাবারের মধ্যে কৃত্তিমতা, আত্মিয়তা আর বন্ধুত্বের মধ্যে কৃত্তিমতা, প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে কৃত্তিমতা। তাই মেট্রোপলিটান জীবনকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে ডিপ্রেশন। ভয়ংকর আফসোস্‌!