এ অবধি বেঁচে থেকে কত সকাল তো দেখছি। তবে কখনও ভাবিনি আজকের সকাল দেখাটা একটু অন্য রকম মনে হবে। কত বছর পরে এলাম গ্রামের বাড়ি। মনে হল এই তো বিগত কৈশোরে দেখা সেই চেনা সককাল দেখছি যেন। গাছে গাছে দোয়েল, বক, ডাহুক, ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরে মেঘের ফাঁকে  সকালের সূর্য ঊঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল ঝিরি ঝিরি নারিকেল পাতার আড়ালে। সেই চেনা সূর্য, এ সূর্য যেন গ্রামের, এ সূর্য যেন নারকেলি পাতার সূর্য।


হঠাত এখন বৃষ্টি এল। নাড়ি পোঁতা ভিটেয় অনেক বছর পরে আজ আকাশে মেঘ বৃষ্টির খেলায় জাম গাছ, আম গাছ, কদম, জলপাই, জামরুল আর কামরাঙা গাছের শরীর ভিজে যেতে দেখছি। ছোট কালের কথা মনে পড়ে গেল। পেটে জামের বিচি চলে গেছে,  কোন এক মুরুব্বি যেন বলেছিল এবার আর রক্ষে নেই! পেটে জাম গাছ জন্ম নেবে। তারপরে মাথা ফুঁড়ে উঠবে আকাশে। সে কথা মনে পড়ে আজ খুব হাসি পাচ্ছিল। মনে হল যেন এইত সেদিনের কথা। কিন্তু আজও জামগাছটা আর জন্ম নিল না। বরং দেহের মধ্যে জন্ম নিল কিছু মরণ অসুখ। যা অলক্ষ্যে অজান্তে ভেতরে ভেতরে বড় হচ্ছে দিনের পর দিন।  


বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে  টিনের চালে। টুপ্‌ টুপ্‌, ঝম্‌ ঝম্‌। টাপুর টুপুর। সেই চেনা শব্দ। বৃষ্টি হচ্ছে ডুমুর গাছের পাতায়। পাতারা কেমন মাথা দুলিয়ে উঠছে, তারা যেন দোল খাচ্ছে, সেই চেনা দোলনা। বৃষ্টি হচ্ছে  তাল গাছ ছুঁয়ে শ্যাওলা পুকুরে, পুকুর ঘাটে।, বৃষ্টি হচ্ছে জানালার কার্নিশ ঝুলে। বৃষ্টি যেন হচ্ছে সারা মনের জমিন জুড়ে। কেমন অনেক চেনা সে বৃষ্টি, অনেক চেনা সে বৃষ্টি পড়ার শব্দ।


আম গাছের ডালে বৃষ্টিতে ভিজে একটা কাক ডাকছিল। কা কা কা করে এমন ভাবে ডাকছিল- কানের মধ্যে সে ডাকের ঝনঝনানীতে যেন তালি লাগার জোগাড় হল কানে। তবুও ভালো লাগছিল। আহা এ যেন সেই ছোট বেলায় কাকের বাসা ভাঙার আয়োজন নিয়ে কাকের সাথে ঝগড়া করার কথা মনে করিয়ে দিল। কাকের সেই রাগ, সেই  গলা চিরে ডাক। শহুরে জীবনে এমন করে কাকের ডাক কতদিন শুনি না।
ভীষণ কর্কশ সে ডাক তবুও ভালো লাগছিল !


সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মনে হল আহা এ তো সেই শরতের বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা। এখন আকাশে মেঘের গুড়ু গুড়ু শব্দে চমকানো বিদ্যুৎ চারিপাশ। খোলা জানালা দিয়ে ঝলকানো আলোর প্রবেশ। আধো ভয় শিহরিত বুকে সে আলোয় চোখ জুড়ায়। কি যেন আগামী বার্তা দিতে চায় অকাল বৃষ্টি। শরতে দূর্গা পূজার কথা মনে করিয়ে দিল। কালিবাড়িতে সান্ধ্যকালীন শাখ ঢাকের আওয়াজ। আজ মহালয়া, রাত্রির শেষ প্রহরে চন্ডী পাঠের সুর ভাসা ক্ষন অপেক্ষায় যেন। প্রসাদ খাওয়ার কথা মনে পড়তেই তার গন্ধ ভেসে এলো নাকে। আতব চালের সাথে দুধ কলা চটকানো প্রসাদের সেই চেনা গন্ধ।


দূর মিনারে মুয়াজ্জ্বীনের আজানের  ধবণিতে চমকে উঠি। ভাবি আজও কি মিনারে উঠে মুয়াজ্জ্বীন আযান দেয় ‘আল্লাহু আকবর’। সেই সন্ধ্যা আযানের শব্দ, সেই সন্ধ্যা পূজার ঘন্টা, সেই মেঘ গুড় গুড় শব্দ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় আমার সত্তার মধ্যে। যেখানে আজও অজান্তে আর বড্ড অযত্নেও হারিয়ে যাওয়া একটা কৈশোর মন শেঁকড় গজিয়ে আছে বাবার ভিটেয়। অথচ সে মন এখনও হারিয়ে  যায়নি শহুরে বিচিত্র জীবন মেলায়। বরং সে মন আদি অস্তিত্বের কাছে ফিরে গেলে আজও জীবন্ত হয়ে ওঠে ফেলে আসা সকল অতীতকে নিয়ে, আর মনে হয় এইত সেদিনের কথা।


১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০।