মায়ের কথা মনে পড়তেই আজ মনে পড়ে গেল
সেই খড়িচুলা পাক ঘরের গ্রাম্য চিত্রের কথা। মা আমার  
দিয়েশলাইয়ের কাঠি ধরাতে পারতেন। সেই আগুন দিয়ে
সকালের খড়িচুলায় আগুন ধরানোর কত কশরত করতেন।
বাঁশের ফুকনিতে ফু দিতে দিতে ধূয়ার আধারে শুরু হতো  
চোখ জ্বলা, চোখে পানি, হাতে শাড়ির আঁচলে এ চোখ ওচোখ
মুছা, আবার ফুকনিতে ফু দিয়ে আগুন উসকীয়ে রান্নার
আয়োজন।


বর্ষায় দিয়েশলাইয়ের কাঠি বড্ড কষ্ট দিত মাকে। বোধ করি
মায়ের কাছেই প্রথম দেখা কি ভাবে দিয়েশলাইয়ের কাঠিতে
আগুন ধরাতে হয়। আচ্ছা মা কি কখনও কোন দিন ভেবেছিলেন
এই একটা ছোট্ট দিয়েশলাইয়ের কাঠি আমাজনসম বন পুড়িয়ে
উজাড় করতে পারে। কোনদিন কি বাবার উপর,অথবা আমাদের
উপর মা রাগ করে ভেবেছিলেনঃ “ রাখ তোর রান্নার আয়োজন,  
এত কষ্ট সহ্য হয় না।“ আজ সে কথা জানতে বড্ড ইচ্ছে করে।


পোড়া খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত আদি অভ্যাস।
মানুষ যখন আগুন ধরানো শিখল তখন থেকেই পোড়ানো
খাদ্যের প্রতি ছিল জিহবায় লোল পড়া স্বাদ। তাই বুঝি আমারও
জিহবায় আগুনে পোড়া খাবার কেমন তৃপ্তি নিয়ে আসে
ভেতর থেকে। মনে পড়ে মায়ের খিঁচুড়ি বা পোলাও রাঁধা হাড়ির
তলায় কি ভাবে খুঁজে খুঁজে খেতাম পোড়া খিঁচুড়ি আর পোলাও।
তখন মন পোড়া সকাল, রোদ পোড়া দুপুর আর আকাশ পোড়া
সন্ধ্যার কথা মনে থাকত না। কেবল মনে পড়ত পাকঘরের কথা।


তখনকার পোড়া খাদ্যের তালিকায় অনায়াসে যোগ হত আলু,
মরিচ, কাঁঠালের বচি, কাঁচা অড়হরের ডাল, ভুট্টা ইত্যাদি।
মনে আছে একবার ইট পোড়া ভাটায় নয়ন জলির কাদা
জলের মাছ পোড়ানোর কথা। বাবার বকুনি, মা’র আহাজারি।
সন্ধ্যায় কি পড়তে বসে আরও কিছু বকুনি খেয়েছিলাম?
মনে নেই। তবে এখনও মনে পড়ে দুধের সর থেকে বানানো
ঘীয়ের পরে পোড়া সরে ভাপ্‌ উঠা কাটারি ভোগ চালের ভাতে
কবজি ডুবিয়ে দিয়ে ভাতের লাড্ডু বানিয়ে খাওয়ার কথা।


মা’র কথা মনে পড়তেই আজ মাকে কত কথা জিজ্ঞাসা
করতে ইচ্ছে হচ্ছেঃ


- তারার দেশে অচেনা বাগানে কেমন আছো তুমি?  
- তুমি তো  দিয়েশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে জানো,
সে কাঠিতে তারার বাগানে আগুন জ্বালিয়ে টুপ করে
খসে পড়তে পারো না রাতের নীল আকাশে। তাহলে
তোমাকে আবার কাছে পাওয়া যেত।
- তোমার সময় কি করে কাটে মা?
- আমার কথা কি মনে পড়ে তোমার?
- খড়িচুলায় কি খিঁচুড়ি, পোলাও রাঁধো? হাড়ির তলায় কি
পোড়া লাগে? আমার জন্য কি আবার একটু রাঁধতে ইচ্ছে হয়?
- ওখানেও কি বৃষ্টি হয়, সকাল সন্ধ্যা কিংবা রাত্রি হয় মা?
- তোমার ঘুম, ডাক্তারী ব্যাবস্থা পত্রের ফাইল, ঔষধ গুলো তো
নিয়ে যাওনি। ওগুলো পড়েই আছে, কখনও কখনও তোমার
এক্সরে, ইকোকার্ডিয়োগ্রাম, ক্রিটিনাইন সহ ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট
গুলো দেখলে আতকে উঠি, ভাবি আজ না তোমার খালি পেটে
রক্ত দেয়ার কথা ছিল।
- তোমার শয়ন কক্ষে যাই, বসে থাকি, সারা ঘর ময় তোমার গন্ধ
এসে লাগে, তোমার পায়ের শব্দ শুনি, ঘুমে থাকা ঈষত নাক ডাকার
শব্দ শুনি, আমি শুনতে পাচ্ছি আমার নাম ধরে তুমি ডাকছ। কিন্তু
তোমাকে ধরতে পারি না, তোমার কাছে বসতে পারি না।
- নাকে পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে যাই রান্না ঘরে ভাবি সেখানে তুমি কি
আদর করেই এবার পোড়া রান্না বসিয়েছো আমার জন্য?  নাকি
সংসারের চিন্তায় চুলোয় উঠানো খাবার আজ পুড়ে পুড়ে ছাই হতে
বসল।


এমন অনেক কথাই মনে পড়ে। তুমি চলে গেলে অথচ
বলে গেলে না এ ভাবে চলে গেলে আর আসা যায় না।
মা তুমি তো বলেও যাওনি আমার পোড়া স্বাদের
রান্নার পছন্দের কথা। ভালই করেছো মা। আজ যে আমি
নিজেই পুড়ে পুড়ে যাচ্ছি প্রতিদিন। এমন সংসার, সমাজ আর
জাতীতে জন্ম দিয়েছো মা এখানে প্রতদিনবেঁচে থেকেই পুড়ে
যেতে হয় অসহ্য কষ্ট পাওয়ার জন্য। কেননা তোমার
সাজানো বাগানে এখনঃ    
- প্রতিকূল শিক্ষা ব্যাবস্থা ও শিক্ষা পরিবেশ
- বিকৃত সংস্কৃতির আগ্রাশন
- নিরাপত্তাহীনতায় সুস্থ বিচারিক আদালত
- ঊর্ধ মূল্য গতির খাবারে ভেজাল
- অব্যাবস্থাপনায় চিকিতসা ক্ষেত্র
- শারীরীক ও খেলা ধূলার ক্লাবে ক্যাসিনো ও মদ- জুয়ার আড্ডা
- বেকারত্বর অন্ধকারে নিষিদ্ধ নেশার সহজ লভ্যতা
- সাহিত্য আর সংগীতের ভান্ডারে কবিতা আর সুর চোরের আখড়া
- নিরাপত্তাহীনতায় আমাদের প্রাত্যহিক জীবন


তাই এখন আর খাদ্য পুড়ে না। এখন জীবন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়,
পরিবার পুড়ে পুড়ে ছাই হয়, সমাজ পুড়ে পুড়ে ছাই হয়। তাই পোড়া
খাবারের পরিবর্তে ভয় পাই সিঁদুরে মেঘ দেখে আর ভাবি আবার কোন
ঘর পুড়ে ছাই হচ্ছে কোথায়!