এখন মনে হয় বাংলার আকাশে প্রভাতের সূর্যয়ও
থাকে বিচলিত। তারপর ঢলতে ঢলতে বিষণ্ণ মনে
বিদায় নেয়। সন্ধ্যাকাশে রেখে যায় কিছু প্রশ্ন, কিছু
অনাকাঙ্খিত শব্দ আর স্বপ্ন ভঙ্গের চিহ্ন। তাইত সাঁঝে
আবিরের শুভ রং হয়ে যায় ছোপ ছোপ রক্ত রাঙ্গা
যুবতীর শাড়ি অথবা বেকার যুবকের ভিশেরা তথ্যের শার্ট।


এখন প্রশান্তির আহ্‌! শব্দগুলি হয়ে যাচ্ছে আহারে!
বাহ্‌ শব্দগুলি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে বাবারে! চারিদিকে
কষ্টের শব্দরাই এখন ইশ্‌!, উহ্‌!, চুঃ! চুঃ! চুঃ! চুঃ!
করতে করতে মৃদু থেকে  আরও জোরালো হচ্ছে।
তারা বাংলার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার
যেন ফিরে আসছে আর একটি কষ্টের সকাল হতে।


আমি রাতের আঁধারে কান পাতি। যতদূর কান যায়
ততদুর শুনি অশুভ শব্দ আর কান্না। হয় কেউ খুন হয়েছে,
কেউ ধর্ষিতা হয়েছে, কেউ পৈত্রিক ভিটে ছাড়া হয়েছে, নয়ত
কেউ গুম হয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে পুলিশ করিডোরে
কাঁদছে ক্রস ফায়রের তথ্যের জন্য। এ যেন কেবল কান্না,
কেবল কষ্ট। যেন কষ্ট শুধু কষ্ট, কান্না আর কান্না।


আমি এখন রাতের আকাশ দেখতেও ভুলে গেছি।
কত দিন যে খসে পড়া তারার দৃশ্য দেখিনি মনে পড়েনা।
কত দিন শুক্লা পক্ষের চাঁদের আলোয় নিজেকে ভিজাইনি
মনে নেই। এখন রাতও যেন সারাক্ষন কোন অশুভ
আতংকে হয়ে থাকে জড়সড়। আকাশের মেঘের চেয়েও
আমার কষ্টের কালো মেঘ এখন এত গাঢ় যে রাত তার
আতংকিত মুখ লুকাতে চায় আমার কষ্টের গভীরে।


আমার ভাবনারা এখন তাই অতি বেয়াড়া। আমি
ভালোবাসার কথা বললে আমাকে বিরহের কথা শোনায়,
আমি শান্তির কথা ভাবলে আমাকে রক্ত ঝরা শাড়ি আর
রঞ্জিত শার্টের কথা শোনায়, আমি স্নেহ মমতার কথা
ভাবলে আমাকে শোনায় বখে যাওয়া জীবনের গল্প, আমি
কবিতার কথা বললে আমাকে শোনায় ষড়যন্ত্রের কথা।
তাই এখন আমার ভাবনারা কেবলই নিয়ন্ত্রনহীন,  
বড্ড বেয়াড়া এবং বেত্তমিজ!  


এখন মনে হয় ইশ! কেন একটু আগে জন্ম হল না আমার?
যখন বাংলায় প্রভাতের সুরয্যের হাসি গলে গলে পড়ত
নদীর ঘাটে রমণীর ভেজা চুল আর শাড়ির ভাঁজে, কিংবা
যুবকের বলিষ্ঠ হাত নিয়ে করত খেলা আবাদি মাটির বুকে।
যখন শিউলি ফুলের গন্ধে জেগে থাকত রাত প্রীতিটি রাত
বাসর করে সাজাতে, সন্ধ্যারা হতো নির্ভার বাড়ি ফেরা
মানুষের শঙ্কাহীন, কষ্ট বিহীন নিরাপদ আশ্রয়।


তবুও আমি আশায় বুক বাঁধি। এযে আমার বাংলাদেশ,
আমি যে বাঙালী, আমি স্বপ্নও দেখি বাংলায়। আমার
প্রভাতের সুরয্য, সন্ধ্যার আকাশ, মেঘের রাত্রি, আমার
কষ্ট, কান্না, আহাজারি সবই যে বাংলার প্রান্ত ছুঁয়ে তার
রুপ, রস আর শোভা দিয়ে সাজানো। আমার রক্তেও যে
ইতি পূর্বে গত হওয়া প্রাচীন মানুষের প্রবাহ এখনও
বর্তমান। সে ধারার শব্দে আজও খুঁজে পাই পদ্মা,
মেঘনা, যমুনার আদি কপম্পন, খুঁজে পাই কূল ভাঙার
বিপরীতে চিরায়িত আর একটি নতুন কূলের সন্ধান।