আরসলা, মশা, মাছি, ছারপোকা, উকুন প্রতিদিন  
এমন অনেক কীটপতঙ্গ বড্ড বিরুক্তিকর। তাইত
সময় সুযোগ পেলেই আমরা ওদের মেরে ফেলি।
আবার কখনও কখনও মায়া হয়।কেন মায়া হয়!
কিছুক্ষন আগেও যে জীবে প্রান ছিল সে এখন মৃত।
ওর হত্যাকারী আমি। কি মর্মান্তিক।এটা ভেবে তাই
অজান্তেই মনের ভেতর কষ্ট হয়, মায়া হয়, বড্ড মায়া!


কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে, বুয়া, একটু ভুল
করলেই কষে চড়-থাপ্পড় লাগিয়ে দিই। তারপর
আবার কেমন মায়া লাগে। কেন লাগে? ভাবি
ওদের তো আপন বলতে কেউ নেই, প্রতিবাদ
করার সুযোগ নেই,ওরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ।
নিজের ছোট ভাই-বোন, কিংবা সন্তান হলে ওরা
কি এমন করে মার খেত!তাই তখন মায়া হয়,
বড্ড মায়া! বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠে,
অলক্ষে তখন ক্ষমা চাই বিধাতার কাছে।


দেখি রিক্সাআলা নেহায়েত অশিক্ষিত আর দুর্বল বলে
সড়কে কেউ কেউ তাকে একটু ভুলের জন্যই গালি  
দেয়, ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। তখন মায়া
হয়, বড্ড মায়া! এমনই এক রিক্সা চালকের মুখ
দেখে সেদিন বড্ড মায়া লেগেছিল।ওর রিক্সায় চড়ে
যেতে যেতে তাই জিজ্ঞেস করি-


“তোমার বাড়ি কোথায়?”


রিকশা চালক কথা বলছে না। একটু আগেই
লাঞ্ছনার ঘা তখনও দগ্‌ দগে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস  
টেনে গামছায় চোখ মুছতে মুছতে বলে-  


“হামার বাড়ি অম্পুর বাহে।”


“ঢাকায় কত দিন হল?”


আবার কথা নেই। হয়ত মনে পড়ে যায় তার
ছোট্ট গ্রাম, ছোট্ট সংসার, বউ আর সন্তান মিলে
ছোট্ট জীবনের কথা।একটু সময় নিয়ে বলতে থাকে-


“বাহে হামার দুক্কের কথা আর কি শুনবেন,
হামরা কচু ঘেচু খওয়া দ্যাশের নোক, ধন্না নদীর
পাড়ত হামার গাঁও। বেটি ছাওয়া মানসীর স্বপ্ন।
মোক কলি”-


“সবাই ঢাকাত জাওছে, তম্রাও তো এনা ঢাকাত যাবার
পারেন।কত জনা ঢাকাত্‌ জ্যায়া বড় নোক্‌ হলি। তোমরা
টেকা পাইসা কামাই করি ধরি আইসেন, এনা সুখ চাই!  


“কত কনু এইঠেই তো হামরা ভালো আছি, দু’বেলা পেটত
যা জুটে তাই হামার ভালো। ওই ভিন দ্যাশত জ্যায়া
কি- না কি হয়, তোমাক ছাড়ি যাবার মন চায় না।
ক্কায় শোনে মোর কথা। তা তো তোমরা নিজের চোখোত
দেখলেন। আজ হামাক অসম্মানি করলি।”


বলতে বলতে রিক্সা চালক আবার চোখের জল মুছে।
ও চোখে তখন জল নয় যেন জিগার আঠা
রক্ত হয়ে ঝরতে চায়।


বললাম- “ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেইতো পার”।


“মায়া বাহে মায়া। বউটার স্বপ্নের জন্যি মায়া নাগে।”


ভাবলাম, রিক্সা চালকেরও মায়া আছে!টাকা ছাড়া
আবার কিসের মায়া? জানতে বড্ড ইচ্ছে হল।
তাই জিজ্ঞেস করলাম-


“ তোমার আবার কিসের মায়া?”


রিক্সা চালক আমায় অবাক করে দিয়ে  বলল-


“স্যার, সামনে করবানী ঈদ,এলা কত পশু কোরবানি হইবে।
নামাজের দিন পশুগুলার চোখোত্‌ চায়া দেখছেন? ওমার
চোখোত্‌ পানি ঝরে, হামার বড্ড মায়া নাগে, তখন ভাবি
পশুর নাগি এত মায়া, তাইলে বউটার জন্যি কেন মায়া
হবার নয়। বউটার কত শখ, হামার একখান্‌ টিনের ছাওয়া
ঘর হইবে, ওই ঘরের চালের নিচত্‌ পায়রা বসি বিহানে
আর সঞ্জাত বাক্‌ বাকুম করি ডাক পাড়বি, ছাওয়াকুনা
মোর নাফ দিয়া কোলোত্‌ চড়বি, বউ মোর পান-গুইয়া
নিয়া মুখত্‌ দিবে। উঁ-হ্‌! আহ্লাদ যেন ধরে না। কত স্বপ্ন,
কত মায়া। তাই এলা ঢাকা ছাড়ি যাবার মন চায় না।”


এবার আমি বাক রুদ্ধ হোই। ভাবি “মায়া সভ্যতার”
মানুষের মায়া কেমন ছিল, কেমন ছিল নবী(সঃ)-র মায়া,
বুদ্ধ দেবের মায়া। আমরা কি তার একটুও বুকে ধারণ
করতে পারব না? আমরা কি মানুষ হয়ে পারব না প্রকৃতির
সকল জীবকে ভালবাসতে? তাহলে তো চারিপাশে এত হত্যা,
খুন, মৃত্যু, ধর্ষণ অথবা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কাঁদত না
মানুষ। মায়া লাগত।মায়া লাগলে মানুষ বাঁচত। আর মানুষ  
বাঁচলে বাঁচত প্রকৃতি, বাঁচত কীটপতঙ্গ, পশুপাখি।  

---------------------------------------
প্রান্তিক ভাষার শব্দার্থ
........................  
অম্পুর=রংপুর, বাহে=বাবা=বাবাজান, হামার=আমার, দুক্কের=দুঃখের,
নোক=লোক, ধন্না=ধরলা নদী, বেটি ছাওয়া=মেয়ে মানুষ(এখানে বউ),
মোক কলি=আমাকে বলল, জাওছে=যাচ্ছে, জ্যায়া= যেয়ে, তম্রাও=তুমিও,
হলি=হলে, টেকা পাইসা=টাকা পয়সা,  চোখোত্‌=চোখে, চায়া=চেয়ে,
কনু=বললাম, এইঠেই=এখানে, ক্কায়=কে, ওমার=তার=ওর, নাগে=লাগে,
পায়রা=কবুতর, ছাওয়াকুনা=সন্তানটা, বিহানে=সকালে, সঞ্জাত=সন্ধায়,
পান-গুইয়া=পান-সুপারী, এলা=এখন


“মায়া সভ্যতার”(Maya Civilization)
............................................
এটা মেসো-আমেরিকান সভ্যতা। ৭০০০ খ্রিষ্ট তে এর গোঁড়া পত্তন শুরু হয় এবং মধ্য মেক্সিকো থেকে শুরু করে গুয়েতেমালা, বেলাইজ, হন্ডুরাস, এল-সাল্ভেদর, নিকারাগুয়া, উত্তর কোস্টারিকা হয়ে মধ্য আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু সংক্ষেপে একে মেসো-আমেরিকা বলে।খ্রিষ্ট পূর্ব ৩০০ থেকে ৭০০ এর মধ্যে মায়া সভ্যতার চরম উন্নতি হয়। তারা সাহিত্য, সংগীত, শিল্পে আধুনিকতার শিখরে আরোহন করে।সৃজনশীলতা এবং স্থপত্য শিল্পে বিপ্লব আনে। এ সব নিদর্শন এখন ইতিহাস।