তোমার বাড়ি যেতে রাস্তায় রেল ক্রসিং পড়ে, ওটার সাথে একটা লাল
গুমটি ঘর ছিলো। ফিরিংগিরা নীল চাষ করলেও এ দেশে কেন যে লাল
রংগের ঘর বানাত কে জানে!  শুধু এ টুকুর ভরসাতে অনেক বছর পর
রাস্তাটা ধরে হাঁটছিলাম। এখন আর এটা কাঁচা রাস্তা নয়, বসন্তের হাওয়ায়
ধুলো উড়ে না, ধুলোর আস্তরনে প্রকৃতির সবুজ ম্লান হয় না, যেমনটি ছিল
আগে। তোমাকে কাছে পেতে ঐ ধুলোও গায়ে মাখতে এতটুকু কষ্ট হত না,
বরং কত সময় চুরি করে অনেক বাহানায় হাজির হতাম তোমার মহামোহ
আঙ্গিনায়।


রাস্তার দু’ধার ঘেঁষে এখন অনেক উঁচু উঁচু দালান-কোঠা, রকমারি দোকানপাট,
কাঁচা বাজার, মুদি দোকান, টি-স্টল, সেলুন, হিন্দী গানের  সি ডি বাজার...
সব খানে যেন গ্রাম্য উন্নয়নের মিশেল ছোঁয়া। অথচ এক সময় তোমার বাড়ির
এ রাস্তা মাড়িয়ে যেতে যেতে শুনতাম পাখিদের গান,শুনতাম রাস্তার সাথে হাত
বাড়িয়ে ফসলী ক্ষেতের যশস্বী আহ্বান, রেল সড়ক ধরে হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের
পরিচিত আওয়াজ। দেখতাম আম, জাম, জারুল আর বাবলার ছায়ায় ক্লান্তি
ঝরানো পথিকের ফোটন দৃষ্টি নিজ গন্তব্যে।    


তিন রাস্তার মোড়ে পুরনো বট গাছের ভরা যৌবন কারা যেন ছেঁটে দিয়েছে।
সে ভূতড়ে ভাবটা আজ আর নেই। তবুও তার মূল কান্ড ঘেঁষে ছোট্ট রাধা-কৃষ্ণের
মন্দিরটা যেন ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। এর চারিপাশ দিয়েও গ্রাম্য
দোকানের বেহাল প্রতিযোগীতা। তবুও রকমারী ঝুলানো অনেক পন্যের ফাঁক গলিয়ে
দেখা যায় মায়ের মন্দির। দেয়ালের পলেস্তরা খসে গেছে, রাধার রঙ ঝলসে গেছে,
কৃষ্ণের বাঁশি গেছে ভেঙ্গে। সন্ধ্যা বাতিও আর জ্বলে না। এতেই বুঝা যায় চন্ডিপুরের
আদিবাসির দুরাবস্থা কোন সীমায়।


নিজেকে কোন একদিন রাধা-কৃষ্ণের মুখোমুখি করেছিলাম তোমার কপালে সিঁদুর
পরিয়ে দেয়ার কৈশর আবেগে, সে কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বরং বড্ড
কষ্ট হচ্ছিলো নিজেকে মানুষ ভাবতে। তাই তোমার বাড়ির রাস্তায় সম্মুখে আর পা
ফেললতে পারিনি এক কদম। তা ছাড়া আশপাশের অসম আধুনিকতা, মন্দিরের
দুরাবস্থা, অচেনা কালচারে নতুন মানুষদের চলাচল বলছিলো তোমরা কোথাও হারিয়ে
গেছো। তোমাদের ঠিকানাও বদল হয়েছে নিশ্চয় জন্ম ভূমির মায়াকে আতংকের
জলে ডুবিয়ে। তাই তোমার বাড়ির রাস্তা আমার স্মৃতির মোহনায় এখন চোরা গলি।