আমি তখনও রাস্তায় যখন ট্রেন ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে। তোমার চোখে যে বিরহের
ব্যাকুলতা উথলিয়ে উঠছিল তাকে অবজ্ঞা করা সত্যিই ছিল কঠিন। তবু জীবনের
তাগিদেই  পা বাড়াতে হয়েছিল সম্মুখে। পকেটে মোটা অংকের বিনিময়ে প্রাপ্ত
শীততাপনিয়ন্ত্রিত বগির টিকিট, সাথে পরিধেয় বস্ত্র আর প্রত্যহিক কস্মেটিক্সের
ব্যাগ। তার পকেটে নিত্য ঔষুধের পুটলি। কিছু কলম আর সাদা কাগজ। কি জানি
কখন তুমি কবিতা হয়ে ঘাড়ে চেপে বস, তারই প্রস্তুতি ছিল বরাবরের মতই।


আর একটা ব্যাগে যতটুকু ধরে ততটুকুই কেবল বই আর বই। সবই প্রায় বাংলা,
ইংরেজিটা পড়তে পারি না তা নয়। আসলে সব আস্বাদন ঢেলে পড়তে সময় হয় না
বাংলার ভীড়ে। বাংলা অভিধানটা, ওটা সঙ্গে না থাকলে আজকাল কেমন অসহায়
লাগে। মনে হয় বিরহ থেকে বিরতির বিড়ম্বনায় আমি বিসুখে ভুগছি। তার পর
কবিগুরুর সঞ্চয়িতা, বিদ্রোহ কবির সঞ্চিতা, গোলাম মুরশিদের হাজার বছরের
বাংগালি, কিছু কিশোর গল্প, উপন্যাস আর আমার লেখা বেশ কিছু বইয়ের সাথে
সদ্য প্রকাশিত শেষ কাব্য গ্রন্থ- আমি  যেন এক বেজন্মা ফেরারী।


ট্রেন এবং বাসের ছাড়ার সঠিক সময়ের সাথে বরাবরই তোমার কেমন জানি
একটা অবিশ্বাসের দোলাচাল। হতে পারে কোন জীবনে ট্রেন অথবা বাসের জন্য
সঠিক সময়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় দেহ আর মনের সাথে করেছিলে
অসম যুদ্ধ। অভিমানে খেতেও চাওনি জিদ করে, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা দাউ দাউ
করে জ্বলছিল অর্ধ কপাল জুড়ে। কার উপর রাগ হয়েছিল এত ভয়ংকর এখন
হয়ত তা আর মনেও নেই। তবে ট্রেন আর বাসের সময়ের সাথে বিরোধটা
এখনও আগের মতই। তাইত ট্রেনের সময় ঘনিয়ে আসলেও তোমার মুখে
সেই একই কথা- কখনও ঠিক সময়ে আসে না বাংলাদেশের ট্রেন।  


ষ্টেশনের দিকে তাই  যাত্রাটা শুরু হল বিলম্বেই। যদিও আমি বরাবরই সঠিক সময়ে  
ষ্টেশনে হাজির থাকা যাত্রি। অথচ আজ তোমার অনুযোগের ভাষায় টের পাচ্ছিলাম
কেমন যেন এক অপরিচিত ভালবাসা, কি জানি- হবে হয়ত! মনে মনে আমিও তাই
অজান্তে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম কি না কে জানে। তাইত ট্রেন ষ্টেশনে, আমি পথে
তখনও বিলম্বিত যাত্রায়, খারাপ লাগছিল না তবুও এতটুকু। একবার হয়ত ভেবেছিলাম
ট্রেনটা মিস হলেও মন্দ হয় না, তোমাকে কাছে পাওয়া যাবে কিছুটা সময়। যে সময়ের
সাথে তুলনা হয়না টিকিট ভাড়ার অংকের, কবিগুরুর সঞ্চয়িতা, বিদ্রোহ কবির সঞ্চিতা,
রাত্রির বৌদ্ধ পূর্ণিমা, অবলা নদীর শান্ত স্রোত আর আসন্ন কবিতার শব্দগুচ্ছ। অথচ
আমি যখন ট্রেনের সিঁড়িতে তখন দেখি ট্রেন তার গন্তব্যের যাত্রা পথে ইতস্ততঃ সচল
আমাকে সঙ্গে করে।