দূরত্ব, অনেক দূর আর দূরের পথ বড্ড ক্লান্তিকর, এক ঘেঁয়েমি আর
মনে হয় সময়ের যেন অপচয়। তাই পথের দূরত্বটা ছিল প্রচন্ড কষ্টের
অথবা এর চেয়ে বরং ঘরকুনো মানুষিকতাই ছিল প্রতিকূল কি এক অদৃশ্য
অলসতার আবর্তনে অথবা কষ্ট আর আরামের মাঝে দগদগে ছিল সুপ্ত
অবুঝ মনের এক অদৃশ্য টান। তাই পথের দূরত্ব ভেবে মন থাকত কাতর।


অথচ সেই দূরত্বই এখন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে আমায় প্রতিদিন।
সেই দূরের পথ আমার সাথে কথা বলে, বাড়ি ঘর দোকান পাট গাছপালা
কথা বলে।  তারা এখন আমার আগমন আর ফেরার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
কুশল বিনিময় করে, নিরাপদ সড়কের জন্য সাবধনতার পাঠ শেখায় প্রতিদিন।  


চোখে চোখে মনে মনে আমি ওদের সকলের খোঁজ রাখি প্রতিদিন যাওয়া
আসার পথে। ভাল লাগে যখন দেখি রাস্তার ক্ষত শরীর ভাল করা হচ্ছে,
ঝড়ের আঘাতে পড়ে যাওয়া গাছটাকে খুঁটি দিয়ে সোজা করে বাঁচানোর
চেষ্টা করা হচ্ছে, খাল বিলের জলে নৌকা ভাসছে, পরিযায়ী পাখিরা নির্ভয়ে
পাখা ঝাপ্টাচ্ছে, ঘর বাড়ির দেয়ালে  চুনকাম হচ্ছে।


দূরত্বটাএখন এত কম মনে হয় যে- এইত এখুনি সড়কের মোড়ে সেই ঝাকড়া  
বট গাছটা চোখের সামনে দাঁড়াবে, দূর থেকে ওকে দেখা যায়। ওর ছায়া তলে
মধু মিয়ার চায়ের স্টল দিয়ে বসা প্রায় তিন যুগ। বট গাছের মত সেও কত
ঘটনার স্বাক্ষী। আমি সময় পেলে এক কাপ চা খাই। কিছুক্ষন কথা বলি।
আজকাল আর বসা হয় না, চা খেলে মধু মিয়া দাম নিতে চায় না, কেমন যেন
দূরত্বটা কমে গেছে। কিন্তু আমার বড্ড খারাপ লাগে। এ খারাপ লাগা দূরত্বের নয়,
অন্য কিছুর।  


আসলে ভাললাগা, ভালোবাসা আর বিশ্বাস থেকে যে কোন মাপের দূরত্ব সত্যিই
একান্ত কাছের হয়ে যায়। তাইত সবে মেরাজের কথা ভাবি, মুহাম্মদ (সঃ) এর  
কথা ভাবি, স্রস্টার কথা ভাবি। আর কত সহজে প্রতিদিন প্রার্থনায় বসে তাঁকে যেন  
দেখতে পাই, তার স্পর্শ অনুভব করি। সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না পাওয়া-নাপাওয়া
অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে কথা বলি। কখনও অভিমান করি বড্ড অভিমান, চোখের
জল ফেলি আবার কৃতজ্ঞতায় থাকি মগ্ন কখনও কখনও।


দেখি তখন দূরত্ব নয় বরং ঘনত্ব নিখুঁত এবং অতীব নিকট। দেখি ঘর কুনো
অলসতা নয় বরং কাজে কর্মে বুনো উন্মাদনা, হাঁড় ভাঙ্গা ক্লান্তি নয়, এ যেন অক্লান্ত
জীবনের কিছু কাজ সম্পন্ন করার নির্ভরতা, গা ঝাড়া দেয়া প্রশান্তি। তখন কোন
দূরত্বই আর দূরের মনে হয় না। পথঘাট গাছপালা বাড়িঘর খালবিল নদীনালা
মানুষজন আপন হয়ে যেন কেবল ছবি আঁকে এক মহান স্রস্টার।