লোকভাষা
পরিতোষ মাহাত


বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে লোক-সাহিত্যের ভাষাকেই ‘লোকভাষা’ বলা হয়ে থাকে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লোকভাষা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন । তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, -
“...বাংলার অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা, এবং তার চেহারা বলিয়া একটা পদার্থ আছে । ... সে আউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় রহিয়াছে । কেবল ছাপার কালির তিলক পরিয়া সে ভদ্র-সাহিত্য সভায় মোড়লি করিয়া বেড়াইতে পারে নাই, কিন্তু তাহার কণ্ঠে গান থামে নাই, তাহার বাঁশের বাঁশি বাজিতেছেই ।”
এ ভাষা সাধু নয়, মান্য চলিতও পুরোপুরি নয়, কোনো একটি বিশেষ আঞ্চলিক উপভাষাও নয় । সাধারণ ভাবে বাংলা লোককথা, লোকগাথা,ছেলেভুলানো ছড়া, ব্রতকথা, আউল-বাউলের গান প্রভৃতি রচনার মধ্যে লোকভাষার নিদর্শন মেলে । এই লোকভাষা হল পুরোপুরি গ্রামীন ভাষা, যা নাগরিক, মার্জিত বা পরিশীলিত নয় । ডঃ পবিত্র সরকারের মতে, –
“লোকভাষা (Folk language) কোনো বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা নয়। নাগরিক ভাষার সঙ্গে – বাংলার ক্ষেত্রে মান্য-মার্জিত কলকাতার বা শহরের ‘শিষ্ট’ ভাষার সঙ্গে বিরোধে যে-ভাষা গ্রাম্য বলে চিহ্নেত হতে পারে তা-ই লোকভাষা । আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে একে কখনও কখনও rural language-ও বলা হয় ।” [ ‘লোকভাষা ও লোকসংস্কৃতি’]
লোকভাষা সাধারণত চলিত ভাষা, মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা কিংবা উপভাষা থেকে পৃথক লক্ষণ বিশিষ্ট । আমরা এখানে লোকভাষার সাধারণ কিছু ভাষা-লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করতে পারি ।
(১) প্রথমত, ভাষার দ্বিস্তরের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। রূপকথায় মানুষ কথা বলে স্বাভাবিক ভাষায় । কিন্তু রাক্ষসেরা বলে – “হাঁউ মাঁউ খাঁউ’ । ভূতপেত্নীর কথাতেও অনুনাসিক স্বরধ্বনির প্রাচুর্য দেখা যায় ।
(২) কখনো কখনো অনুস্বার (ং) ব্যবহার করেও ভুয়ো সংস্কৃত শব্দ তৈরি করা হয় ।  যেমন – আশীর্বাদং, শিরচ্ছেদং ইত্যাদি।
(৩) লোকভাষায় সাধুভাষার ক্রিয়ারূপের ব্যবহার দেখা যায় । যেমন – ‘ উথাল পাথাল সাঁতার কাটিব।’
(৪) অমার্জিত বা অশ্লীল বা গ্রাম্যতা দুষ্ট এমনকি গালি-গালাজের শব্দের অকুণ্ঠ প্রয়োগ লোকভাষার আর একটি দিক । যেমন – ‘মাগি’, ‘ভাতারখাকি’ ইত্যাদি শব্দ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল ।
(৫) ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে, বিশেষ করে আদর বোঝানোর জন্যে ইচ্ছে করে কিছু ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটানো হয় । যেমন – ‘খোকা যাবে ‘বেড়ু’ করতে।’ অনুরূপভাবে জুতা > ‘জুতুয়া’ শব্দটিরও পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে ।
(৬) একটি কোনো বিশেষ শব্দের পুনরুক্তি লোকভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য । যেমন – ‘জল জল যে কর টুসু।’ (টুসু গান) ‘জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।’ (ময়মনসিংহ গীতিকা/ মহুয়া পালা)
(৭) ভাষার চমৎকারিত্ব সৃষ্টি ও সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে অলংকারের ব্যবহার করা হয়ে থাকে । যেমন – ‘মন পবনের নাও’, ‘মন মাঝি’ (বাউল গান)  ‘সোতের শেওলা হইয়া ভাসিয়া বেড়াই।’ (ময়মনসিংহ গীতিকা)
(৮) ধ্বন্যাত্মক শব্দের বিচিত্র ও স্বতস্ফূর্ত প্রয়োগ লোকভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য । যেমন – ‘বাকুড় কুম কুম/ খুখড়াটা কটকটাইল ভাঙল হামার ঘুম।’ কিংবা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।’
(৯) লোকভাষায় অর্থহীন শব্দ প্রয়োগ করা হয় । যেমন – ‘ইকিড় মিকিড়’, ‘এলাটিং বেলাটিং’, ‘আগডুম বাগডুম’ ইত্যাদি ।
(১০) ধ্বনি-বিপর্যাসের প্রাচুর্য লোকভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য । যেমন – লেবু > নেবু, লুচি > নুচি, লোক > নোক।
(১১) অপিনিহিতির বিপর্যস্ত ‘ই’ ধ্বনি রক্ষিত হয়। যেমন – দেইখব, বইলব, মেইরে, ধইরে, রাইত ।
(১২) শব্দের আদিতে অবস্থিত ‘ও’ ধ্বনি প্রায়ই ‘উ’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – কোথা > কুথা, লোক > লুক, কোন > কুন ইত্যাদি ।