কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর ছোট্ট এক গ্রাম- বল্লভেরখাস,
সেই গাঁয়েরই দুখি কিষাণ-মজিদ, করত সোনার চাষ।


স্ত্রী-পুত্র সাথে নিয়ে অর্ধাহারে কেটেছে দিন তার
শত কষ্টেও স্বপ্ন দেখেছে, সুদিনে ফিরবে সংসার।


সোনার বীজ কিনে এনেছে কিষাণ, ছোট্ট মাটির ঘরে,
বুনবে সে বীজ, ফলবে সোনা এক বিঘা জমির পরে।


তমসার দুঃখ আর বেদনা সব ঘুচবে যে তার,
সোনার ফসল ফলবে আর হাসি ফুটবে সবার।


বেদনারা বুঝি স্মৃতি হয়ে রবে তার সনে,
সুখের দিনের কল্পনায়, কিষাণের আনন্দ মনে।


পরম যত্নে কিষাণ পত্নী, স্বর্ণবীজ রেখেছে নিজ ঘরে
সোনায় সোনায় ভরবে সে ঘর, এইতো ক’দিন পরে।


রৌদ্রতাপে মাঘের বেলায় কিংবা পৌষের ইতিতে
কিষাণ তার পত্নী নিয়ে, স্বপ্ন বুনল মাঠের সিঁথিতে।


সন্ধ্যাবেলা স্বপ্ন বুনে, ক্লান্ত যুগলের, ধূসর মাঠ হল হরা,
আনন্দ তাদের সীমা ছেড়েছে, দেখে স্বপ্নে মাঠ ভরা।


বাড়ন্ত দিন গেছে দ্রুত, স্বপ্নরাও পেয়েছে পরম যত্ন
আর বেশি দিন নাই তো বাকি, ফলবে মাঠে সোনার রত্ন।


মৃদু সমীরণে উর্মির উচ্ছ¡লতায়, ভরে উঠে কিষাণের জমিন
সোনা বিকিয়ে কিষাণ এবার, ঘুচাবে যত ঋণ।


তাম্বুল চর্বিত রাঙা ঠোঁটে কিষাণ, একলা হাসে সুদিনের কল্পনায়
স্বপ্নে বিভোর কিষাণের দু’নয়নে, আজ তাই আনন্দ অশ্রু ছলকায়।


প্রিয়তম পুত্র তার কাটাবেনা আর দিন, হেলায় কিংবা অনাহারে
এইবার কিষাণ পুত্রসুখ ছিনিয়ে আনবে, তার ছোট্ট মাটির ঘরে।


এইটুকু বয়সে কত অগ্নিস্পর্শী কষ্ট, সয়েছে কিষাণের ছোট্ট সন্তান
ভাবল কিষাণ, সুখ বিলানোর কালে ছোট্ট নাদানেরে দিবে সর্বাগ্র স্থান।


ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে কেবল, স্বর্ণডগার ক্ষেতে
চৈত্র মাসে কাটবে সোনা, সকলে মিলে যাবে নিতে।


চারিদিকে ধুমধাম, রাজার হুকুমে হবে এবার মহা নবান্ন
নব বৎসরে গোলা ভরবে সোনায়, রাঁধুনির সৃষ্টিতে হবে পলান্ন।


উৎসবে তাই আজ মাতিল রাজ্য, পাখিরাও গাইছে গান সুখে
সুদিনের অপেক্ষায় কিষাণ মজিদ, আশার আলো জ্বালিল বুকে।


অকস্মাৎ একি হল? গগনখানা আজ কেন এত আঁধারকালো?
বজ্রের হুঙ্কার কেন আজ চারিধারে? সূর্য্যিটা কেন জ্বালেনি আলো?


ঝুমঝুম অবিরাম বারি বয়ে যায়, নিঝুম আজি সংসারের চারিধার
একি হলো সর্বনাশ? অকালের কালবৈশাখিতে সোনা ডুবে হাহাকার।


তবে কি আর হল না পূরণ, যে স্বপ্ন কিষাণ দেখেছে কিছুকাল আগে
বিধাতা আজ মেতেছে কি খেলায়, তাঁর অস্তিত্বেও যে প্রশ্ন জাগে।


কিষাণ কিষাণি ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, স্বপ্নভঙ্গের শোকে
সোনার স্বপ্ন ডুবে মিশেছে জলে, যেন পাথর বিঁধিছে বুকে।


এত শ্রম, এত আশা, এত স্বপ্নের হয়েছে নিমেষ জলাঞ্জলী
রিক্তহস্তে আজ জীর্ণ কিষাণ, নায় সাথে এক আনা-আধুলী।


মহাজন যে তারে ছাড়বেনা আর, শোধিতে হবে যত দেনা
কি করে এত কড়ি পাবে কিষাণ, সোনার ক্ষেত যায়না যে চেনা।


লজ্জায় উৎকন্ঠায় কিষাণ, ভাবে মরে, বেঁচে আর লাভ কি এ ধরায়,
গরল সুধা পান করে কিষাণ মজিদ, জগৎ ছাড়ল, স্বপ্নপূরণ ছাড়ায়।