বিয়ের পর নব দম্পতিকে বন্ধুবান্ধব মহল থেকে "হাইফেন" সংক্রান্ত  প্রশ্নের মুখোমুখী  হতে হয় । ইঙ্গিতটা হল বাচ্চা কবে আসছে ? নিতান্তই কৌতুক । তবে এই কৌতুকের মধ্যে একটা সত্যি লুকিয়ে থাকে । একজন নারী আর একজন পুরুষ বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেও সেই বন্ধনকে শক্তিশালী করে সন্তান । সন্তান-হাইফেন বন্ধনকে দৃঢ় করে । শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক তৈরি হয় । কখনও বৈধ সম্পর্ক , কখনও অবৈধ সম্পর্ক । সমাজে সম্পর্কের জাল ছড়িয়ে থাকে । কবিতা বা ভাষিক যে কোনও প্রকাশ / রচনা শব্দ-সম্পর্ক-নির্ভর । শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে ওঠে তা সবাই জানেন । এই সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে কবি শ্রেষ্ঠতম ঘটক ।
কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্ত "কবি" সনেটে লিখেছেন :
                        কে কবি---কবে কে মোরে ? ঘটকালি করি,
                        শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
                         সেই কি যম-দমী ? তার শিরোপরি
                        শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন ?
                        সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
                        যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
                        অস্তগামী ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
                        ভাবের স্ংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ ।
                        আনন্দ, আক্ষেপ, ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে ;
                        অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা বলে ;
                        নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
                        পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে ;
                        মরুভূমে--তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
                        বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে !
                (মধু কবির স্ব-কৃত বানান ও যতি-চিহ্ন অপরিবর্তিত )
তো কবি ঘটক এব্ং কবিকে অঘটন-ঘটন পটিয়সী বলা হয় । কবি যখন শব্দ-সম্বন্ধ নির্মাণ করেন তখন বেশ কিছু অনুঘটকের ব্যবহার করে থাকেন । এই হাইফেন (-) একটি অনুঘটক । শব্দ-সম্পর্ক নির্ণায়ক । কবি সনেটে ৬ টি হাইফেন ও দু'টি ড্যাস ব্যবহার করেছেন ।
হাইফেন ব্যবহারের গুরুত্ব সেভাবে কৌলীন্য পায়নি । কোথায় হাইফেন ব্যবহার করা হবে আর  কোথায় হবে না এটা নিয়ে অনেক লেখক-কবি সেভাবে মাথা ঘামান না  (ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ) । আমি কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি অনেক নাম-করা কবিও হাইফেন ব্যবহারে উদাসীন । অথচ এর ব্যবহারে ও অব্যবহারে যেমন বানান-বৈষম্য ঘটে, অর্থান্তরও ঘটে যায় । এই সাইটে কবিতা পড়তে গিয়ে আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ।  
১) প্রয়োজনীয় হাইফেন ব্যবহৃত হয়নি ।
২) অপ্রয়োজনে হাইফেন ব্যবহার করা হয়েছে ।
৩) নিয়ম মেনে হাইফেন ব্যবহার করা হয়নি ।
৪) কোনও কোনও ক্ষেত্রে যথাযথ হাইফেনের ব্যবহার করা হয়েছে ।


অনেক কবিতা পড়ে মনে হয়েছে কবি বিভ্রান্ত কোথায় হাইফেন ব্যবহার করা হবে কোথায়  হবে না ?
এখানে "হাইফেন" ব্যবহার সম্বন্ধে একটি স্ংক্ষিপ্ত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে হয় ।


১) সমার্থক সমজাতীয় শব্দ যদি একটি ভাবকে নির্দেশ করে, সেই সব উদ্ভাবিত শব্দে হাইফেন ব্যবহার বাঞ্ছনীয় ।
  ক) বিশেষ্য-বিশেষ্য> মা-বাবা-দাদারা এক বাড়িতেই থাকে । (মনঃ-কমলেতে/ নন্দন -কানন )
  খ) বিশেষ্য-বিশেষণ> আকাশ-বিহারী বিহঙ্গ  (যম-দমী)
  গ) বিশেষণ-বিশেষ্য> সুবর্ণ-কিরণ
  ঘ) বিশেষণ-বিশেষণ > লাল-নীল-সাদা ফুলে মালা গাঁথা হয়েছে ।
  ঙ) বিশেষ্য-ক্রিয়া> নাম-করা/ বউ-কথা-কও
  চ) ক্রিয়া-বিশেষ্য> বলা-কথা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না ।  ভরা-যৌবন  ।  
  ছ)  বিশেষণ-ক্রিয়া> মুগ্ধ-করা
  জ) ক্রিয়া-বিশেষণ>  সূচ-বেঁধানো-হিমেল হাওয়া
  ঝ) ক্রিয়া-ক্রিয়া> আসা-যাওয়ার পথ চলেছে/ উদয় হতে অস্তাচলে... রবীন্দ্রনাথ ।


২) নঞর্থক  অব্যয় "না" যোগে সমাস-বদ্ধ পদ যদি গঠ্ন করা হয় তা হলে (-) ব্যবহার বাঞ্ছনীয় ।
  * না-বলা কথা । না-দেখা দেশ । ইত্যাদি ।
৩) বাক্যাংশমূলক সমাস-বদ্ধ পদ গঠনে (-) বাধ্যতামূলক ।
    * সব-পেয়েছির-দেশ । সদ্য-পিতৃহারা-ছেলে ।
৪)  আর্য-ভাষার ব্যাকরণ অনুসারে সন্ধি-বদ্ধ পদ যদি গঠিত হয়, কিন্তু বাংলায় যদি সন্ধি করা না হয় সে ক্ষেত্রে (-) ব্যবহার বাঞ্ছনীয় ।
  * চির-আনন্দ । স্বেচ্ছা-অবসর । কাল-অকাল ।
৫) ইংরাজী বা বিদেশী শব্দের সঙ্গে যদি বাংলা, ইংরাজী বা বিদেশী  শব্দ বা বাংলা শব্দের (তৎসম বা তদ্ভব ) সমাস গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন (-) বাবহার সঙ্গত ।
* ই-মেল । টেলি-সংযোগ ।
৬) ধ্বন্যাত্মক শব্দ লেখার জন্য (-) ব্যবহারের দরকার হয় না ।
* কলকলে  ( মধুসূদন ) । টলটলে ।
৭) অনুকার শব্দের ক্ষেত্রেও (-) ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় ।
* ভাতটাত । ফলমূল ।
  
এক সময় যে কোনও সমার্থক বা সমজাতীয় বা প্রায় সমোচ্চারিত অনুকার শব্দ লেখার জন্য (-) ব্যবহারের বিধান ছিল । নিয়ম অনেক উদার করা হয়েছে ।
এখন আর চেয়ে-চিন্তে না লিখে চেয়েচিন্তে বা বন্ধু-বান্ধব না লিখে বন্ধুবান্ধব লেখা যায় ।
তবে উত্তর বর্ণের আদিতে যদি স্বরবর্ণ থাকে তখন (-) ব্যবহার বাধ্যতামূলক ।
* জানা-অজানা । বিষয়-আশয় ।