ছড়া বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত শক্তিশালী শাখা। এখন ছড়া শুধু আর শিশুদের ঘুম পাড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অন্যায়ের পিঠে চাবুক মারতে পারে ছড়া।কখনো স্বাধীনতার হাতিয়ার, কখনো বা রাজপথের শানিত স্লোগান। তালে-মাত্রায়-বিন্যাসে ছড়া উপস্থাপিত হয় অলংকার নিয়ে। ছড়ার ধ্বনি ধমনী ও শিরাকে করে তেজোদীপ্ত। ছড়া এখন সমাজের এক বলিষ্ট প্রতিনিধি। প্রাচীন লোক সাহিত্যের অন্তর্মূলে ছড়ার জন্ম হলেও, বর্তমানে ভাব প্রকাশের এটি একটি আধুনিক রূপ।ছড়ার অনেক বৈচিত্র আছে। কিছু ছড়া রচিত হয়েছে শুধুমাত্র শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্যে। যেমন.............
‘হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং  
তারা হাট্টিমাটিম টিম’।
_________________
বাকবাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কাল কি?
চড়বে সোনার পালকি?’
__________________
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাল মৃদঙ্গ ঘাঘর বাজে’।
বাজতে বাজতে চললো ঢুলি
ঢুলি গেলো কমলাফুলি "
এসব ছড়া শিশুদের কল্পলোকে নিয়ে যায় অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো। এ জাতীয় ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যের অর্থ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। আবার কিছু ছড়া আছে যা শিশুর মনে এক ধরণের চিত্র অংকন করে থাকে আবার সেই সঙ্গে  প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করে বড়োদের মনে।  ।


উদাহরণ :-
‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন গেল কার বাড়ি
আয়রে খোকন ঘরে আয়
দুধমাখা ভাত কাকে খায়’।


এক মা তার ছোট্ট খোকার জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু খোকন অন্যের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সেই দুধমাখা ভাত এসে কাকে খেয়ে ফেলছে। এই চিত্রটি শিশুদের মনোরঞ্জনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।  অন্যদিকে এই ছড়ার মূল ভাবটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছড়াকার এখানে ‘দুধমাখা ভাত’ বলতে দেশের সম্পদ এবং ‘কাক’ বলতে বিদেশী(ব্রিটিশ) বেনিয়াদের বুঝিয়েছেন ।


‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে?’
শিশু মনোরঞ্জনের পাশাপাশি এই ছড়াতে নবাব আলীবর্দির আমলে মারাঠা কর্তৃক সাবেক বাংলায় লুটতরাজের চিত্র লক্ষ্য করা যায়।  শিশুতোষ ছড়াতেই তাই অনেক সময়ে লুকিয়ে থাকে বড়দের জন্য বড় ধরনের সামাজিক চেতনা।


পশ্চিমবাংলায় দেয়ালে দেয়ালে কিছু ভোটের ছড়া  খুব জনপ্রিয়।
"জোড়া বলদ মারছে লাথ
গরিবের নাই পেটে ভাত
কোথায় দুধ কোথায় দই?
গাছে তুলে কাড়ছে মই"


ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীক চিহ্ন ছিল জোড়া বলদ। তাই কমুনিস্ট পার্টির ছড়াকার রা কংগ্রেসকে বিদ্রুপ করে দেয়ালে ওপরের ছড়াটি লিখেছিলেন।


চীনের চিহ্ন কাস্তে হাতুড়ি
পাকিস্তানের তারা
এখনো কি বলতে হবে
দেশের শত্রু কারা?


উপরের ছড়াটি আবার কমুনিস্ট পার্টিকে ব্যঙ্গ করে কংগ্রেসের লেখা ছড়া।


আশির দশকে লেখা একটি ছড়া :-----
"শোনো দাদা বলে গেলো ঘোষেদের নন্দ
জ্যোতিদার গায়ে নাকি মার্কসীয় গন্ধ
মার্কসীয় নয় মোটে কন ইন-ঠানদি
দুবার দেখেছি শুঁকে একেবারে গান্ধী।  


চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
কদমতলায় কে
প্রমোদ নাচে কেষ্ট নাচে
জ্যোতি বসুর বে


ভোটের আগে এই ছড়ার লড়াই দেখা যায় দেয়ালে দেয়ালে।ভোটের ফলাফল যাই হোক না দেয়ালের আঙিনায় এই মজার ছড়াগুলো ছেলেবুড়ো সবাই উপভোগ করে।


প্রাচীনকাল থেকে ইংরেজী ভাষায় ননসেন্স রাইম প্রচলিত রয়েছে কারণ ছড়ার প্রধান দাবী ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা নয়।ছড়ার  অনেক প্রকার ভেদ আছে।যেমন হাসির ছড়া, শিশুতোষ ছড়া , ভোটের ছড়া, লোকছড়া ইত্যাদি।


নজরুলের ছড়াতে লোকজ উপাদানের ব্যবহারের একটি উদাহরণ দিয়ে আমার লেখা আজ শেষ করলাম ..........
"এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানী,
হ্যাঁ মা আমি জানি,
মায়ে পোয়ে থাকতো তারা,
ঠিক যেন ঐ সোদল পাড়ার জুজুবুড়ির পাড়া!
একদিন না রাজা ......
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপরভাজা!
রানী গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক।"
                                     [খোকার গপ্পো বলা/ঝিঙে ফুল]
  


উপসংহার:-
ছড়া প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেই জন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’